জীবনকে একটা ট্র্যাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করো। দেখবে তুমি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছো। তোমার এই পিছিয়ে পড়াটাকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য করছে পুঁজিবাদি আগ্রাসী মস্তিষ্ক। তোমাকে ফাঁদে ফেলছে দালাল। বিষয়টা হলো তুমি নিজেই ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছো জালে। কারণ তুমি দৌড়ের ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলে। জড়িয়ে পড়েছিলে সভ্যতার উদ্ভট জালে। তোমার- জেতার রেইসে জীবন এখন!
Table of Contents
Toggleঅথচ তুমি সেই ভ্রূণাবস্থা থেকেই রেইসে ছিলে। তুমি একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে জীবনের খুব কাছাকাছি যাচ্ছিলে।
মাঝখানে হঠাৎই তোমার কাছে এলো জেতার আহ্বান। জেতার জন্য কতো বইপত্তর বেরিয়ে গেল, প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটলো। কতো কৌশলে আজ তোমাকে জেতার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। আসলে তুমি কিসের জন্য লড়ছো? কার বিরুদ্ধে লড়ছো? এই লড়াইটার জন্যই কি তুমি জীবন প্রদীপ জ্বালো?
তোমাকে জেতাতে কতো মন্ত্রণা; কতো কারিগরি।
আদতে তুমি কি জিতে যাচ্ছো? তোমার কি জেতার কথা ছিল?
আমি কোনো লড়াইয়ের জন্য জন্মাইনি। এই ভরা যৌবনা পৃথিবীর প্রতিটি বাঁকে বাঁকে আমি হাঁটবার জন্য এসেছি। মিলতে এসেছি কোটি প্রাণের স্পন্দনে। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে আমি ভাগাভাগি করতে এসেছি জীবন।
আমার প্রয়োজন নেই প্রাচুর্য, অর্থ, বিত্ত-বৈভব।
তাহলে আমি কি বাঁচবো না?
বাঁচবার জন্য কি খুব প্রয়োজন হঠকারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করা? নাকি একটা উপভোগ্য সুন্দর সরল জীবনকে খুঁজে পাওয়া? বরষা মুখর এক সন্ধ্যায় সারিন্দা বাজিয়ে গান গাইছে কিষাণ। ছেলেপুলে সব মাতোয়ারা জীবনের বিষ্ময় নিয়ে। কিষাণীর মমতা মাখা দুমুঠো খৈ আর এক আজলা জল বিশুদ্ধ এ ভালোবাসার জীবন থেকে তোমার জীবন বড় হতে পারে না হে নার্সিসাস জীবন। খুব সামনের জীবন নিয়ে ওদের কোনো দুঃশ্চিন্তা ছিল না। অথচ আজ ওরা গান গায় না। সামনের দুর্দিনের যে দুঃশ্চিন্তা তোমরা ঢুকিয়ে দিয়েছো ওদের মগজে তাই নিয়ে ওরা ভুলে গেছে হাসতে, ভুলে গেছে উপভোগ করতে। আসলে তোমরা যতোটা সমাজকে এগিয়ে নেয়ার দাবী করছো- আমি ঠিক তোমরা ততোটাই সমাজকে পিছিয়ে দিয়েছো এই দাবী করছি।
কয়েক কিস্তিতে লেখাটি প্রাকিশত হবে। প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হলো।
জেতার রেইসে মরে জীবন- দ্বিতীয় কিস্তি
জীবন নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক প্রবন্ধ ‘জেতার রেইসে মরে জীবন’। বোকার বিশেষ অনুরোধে- মেহেদী হাসান স্বাধীন প্রবন্ধের দ্বিতীয় কিস্তিটি পাঠিয়েছেন। তাই দেরি না করে পাঠকদের জন্য দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হলো।
এই কিস্তিতে জীবনের ফাঁদ এবং হারিয়ে যাওয়া বিশেষ দিকগুলো উন্মোচন করা হয়েছে খুব নিবিষ্টভাবে।
বোকার পাঠকরা এই পাঠ পড়ে নিশ্চয়ই ঋদ্ধ হবেন- এই আশা করি।
আর অবশ্যই কমেন্ট বক্সে আপনার অনুভূতি প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ তো থাকছেই। পাশাপাশি লিখতে পারেন নিজেও। -বোকা

দৌড়ের ফাঁদ
জীবনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখো, তুমি কি এখনও দৌড়াচ্ছো?
একটানা, অক্লান্ত এক দৌড়—জেতার জন্য, পার হওয়ার জন্য।
কিন্তু কী সত্যিই তুমি জিতে যোচ্ছো? নাকি হারিয়ে যাচ্ছ অনির্দিষ্ট অতলে?
যেখানে তুমি নেই; নেই তোমার কোনো অস্তিত্ব!
পুঁজিবাদ আর দালালের সেই ফাঁদে তুমি নিজেই জড়িয়ে পড়েছো, তুমি দৌড়াচ্ছো তাদের খেলার নিয়মে, যেখানে নিজের সুখ-শান্তি হারিয়ে ফেলাটাই নিয়ম। এই দৌড়ের মধ্যে নেই কোনো শান্তি, নেই কোনো সুখ। যেন একটা কারাগার, যেখানে তুমি বন্দী, নিজের জীবনকে বন্দী করে রেখেছো অদৃশ্য এক শিকলে।
তাই দৌড় বন্ধ করো, থামো… দাঁড়াও,
নিজেকে শোনো… শোনো জীবনের নিঃশব্দ ধ্বনি।
রেইস মানে কি অন্যকে হারানো?
জয় মানে কি শুধু অন্যকে হারানো? কীভাবে বুঝবে তুমি জিতেছ, যখন নিজে অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছো?
জীবনের জয়- নিজের ভেতরের ভয় আর দ্বন্দ্বকে জয় করবার ভিতর দিয়ে আসে। জীবনের জয় হয় নিজের ভুল-ত্রুটিকে উদ্ভাবন উত্থাপন প্রকাশ করে লজ্জিত হওয়ার মাধ্যমে। অতোটা মজবুত কি তোমার বোধি মন?
সারা জীবন হারানোর ভয়ে দৌড়ানো মানুষের হৃদয় কখনো পূর্ণ হয় না। সত্যিকারের জয় হয় তখন, যখন তুমি নিজেকে ভালোবাসো, নিজেকে বোঝো, নিজের সঙ্গে শান্তিতে বসো। আর বলতে পারো, অনুভব করতে পারো নিজের মতোই অন্য একটা প্রাণকে!
তাই বলি, সত্যিকারের জেতা অন্যকে হারানোর মধ্যে নয়, বরং অনেক কিছু হারানোর পর অনেক হেরে যাবার পরও নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে।
আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া হাসি
এই দেখো, একটিবার ভাবো- শিশুর সেই অনাবিল হাসিটা আর কই? হারিয়ে গেছে তাই না? বইয়ের বোঝা, ডিভাইসের বোঝা, নতুন দিনের প্রস্তুতির বোঝা, শাসনের বোঝা, ভালো নম্বর তোলার বোঝা আর জেতার বোঝা তো আছেই!
তোমার শিশুটা কি আর হাসে, সেই অনাবিল হাসি?
ভেবো দেখে, বন্ধুর সঙ্গে আর খোলা মনের আলাপ নেই। চায়ের কাপের ঝড়টাও নেতিয়ে পড়েছে। পাড়ার কোন ছেলেটা কোন মেয়েটার প্রেমে পড়লো তার খোঁজও নেই; আছে সেক্স! কথায় কথায় সেক্স!
ভেবে দেখো- সেই অল্প চাহনীর মেয়েটাও আজ তীব্র চাহনী আর উন্মত্ততায় মাতাল। যা ছিল প্রকাশিত তাই যেন ছিল অপরূপ সুন্দর। আর এখন কতো কিছু প্রকাশিত করবার আয়োজন। জীবন হয়ে গেছে শরীরময়।
আচ্ছা বলো তো, সেই মা কই? যে মায়ের মলিন মুখটাও যেন- ছিল এক সজীব সুনিবিড় পরম প্রশান্তি। ‘বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি…’ কোথায় সেই মা?
মায়ের মমতার কোমল স্পর্শ, কই? মা এখন খাঁট কাঁপান, ঘাঁট কাঁপান! মা এখন এ ঘরে স্বামী সন্তান রেখে ও ঘরে বয়ফ্রেন্ড লাগিয়ে বেড়ান।
তাহলে তুমি… এই যে দৌড়াচ্ছো, এই দৌড়ে আসলে কি তুমি জিতে যাচ্ছো? নাকি জিতে যাওয়ার ছলে আসলে তোমার হাসি ফুরিয়ে যাচ্ছে?
সেই শিশুটি, যাদের জীবন এখনো সরল, এখনো সাধারণ, তাদের কাছে হয়তো এখনও জীবনের গভীরতা, মায়া আর মানবিকতা বেঁচে আছে।
তারা হয়তো এখনো জানে সুখ শুধু ধন-সম্পদ নয়, সুখ মানে অনিঃশেষ ত্যাগ, অভাব, অনটন, দুঃসহ জীবন অতঃপরও মায়ার বন্ধনে টিকে থাকা, প্রকৃতি প্রতিবেশ নিয়ে চলা। ভালোবাসার স্পর্শগুলোকে মননে স্থাপন করা।
আর অনুভব করা!
আমি জানি তোমরা আমার মতোই যা হারিয়েছো তার সব ফিরে পেতে চাই?
সেই হারানো স্পন্দন ফিরে পেতে চাই?
রেইস নয় আসল পথ
আজ আমি বলি, দৌড় থামাও। জীবনকে বুঝতে শেখো, নিজের অন্তরকে শোনো। জীবন কেবল জয়-পরাজয়ের খেলা নয়। জীবন মানে এক একটি মুহূর্তের আনন্দ, একটি হাসি, একটি ভালোবাসার হাতছানি।
প্রকৃতির কাছে ফিরে যাও, নদীর গান শুনো,
আকাশের অসীমতায় হারিয়ে যাও।
জীবন হলো তোমার সেই পরিপূর্ণতার সময়ের নাম, যখন তুমি নিজেকে পুরোপুরি উপলব্ধি করো, তোমার চারপাশের মানুষদের অনুভব করো।
জেতার রেইস থামিয়ে নিজের পথে হাঁটো। সেই পথে- যেখানে জয় মানে শান্ত নদীটির পাড়ে বসে থাকার মানে, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে তাকিয়ে শূন্যতার অনুভূতিটুকু অনুভব করা। যেখানে জীবন মানে পরম্পরার পথ ধরে বিস্তার করা ভালোবাসার নাম; যেখানে বেঁচে থাকার মানে নিজের মানুষগুলির তরে পূর্ণ বিলীন হওয়ার নাম, হয়তো।