সমরেশ মজুমদার, কবীর সুমন, মিঠুন চক্রবর্তী, বিভূতি, ঢাকা, বাংলাদেশ, কলকাতা, নকশালবাড়ি, মধ্যবিত্ত, বিপ্লব

সমরেশ কেন তার সাহিত্যে নকশালবাড়ি রাজনীতিকে…

Spread the love
Reading Time: 12 minutes

৮ মে ২০২৩, মারা গেলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। জীবদ্দশায় খ্যাতি যশ সবই পেয়েছিলেন প্রয়াত সমরেশ মজুমদার। বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় সমরেশের এমন সব বই-ই পঠন-পাঠন আয়ত্ত্বে থাকায় তাক্ষণিক একটা প্রতিক্রিয়া মনের মধ্যে জেগে বসে। 

শব্দগুলোকে খুব তীর্যকভাবে তুলে আনলে বলা যায়, নকশালপন্থা, বিপ্লব, মধ্যবিত্ত, ফ্যান্টাসি, নব্যপুঁজির এজেন্ডা বাস্তবায়ন, বাজারি আর কারবারির মিলন। 

কিন্তু অতো সাহস তো বোকার নেই। প্রকাশ্যে যা খুশি তা কি লেখা যায়? যা খুশি তা হয়তো লেখা যায় কিন্তু যা খুশি তা’য়ের যথেষ্ট রূপক অর্থবোধকতা থাকলে তা চারপাশের কলকব্জায় আড়মোড়া ভাঙায়।  

তাই সমরেশ মজুমদারের সাহিত্যকে যুক্তিখণ্ডনের নিরীখে বিভাজন করে দেখা উচিত।

খুব গভীরভাবে দেখলে- বিপ্লব ব্যাপারটাকে ফ্যান্টাসাইজ করতে করতে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করার মন্ত্রণা ছিল সমরেশ বাবুর লেখায়! ফ্যান্টাসিতে আক্রান্ত বাঙালি যুবারা আর বিপ্লব করতে পারেনি। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলবে এই ফর্মুলা সুনিপুণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আদতে সাধারণের কোনো গতি না এলেও লাভটা পোস্ট কলোনিয়াল পুঁজিবাদের বিকাশকে আরো প্রকট করেছে। যে সাহিত্য জীবন বিনির্মাণে লেখা সেই সাহিত্য বোকার আরাধ্য! কিন্তু একটা বড় সময় অকাট্য ভেবে ভুল সাহিত্য পড়েই বোকাদের কেটেছে! তবুও সমরেশ মজুমদারের চলে যাওয়া বোকাদের ব্যথিত করে। ভালো থাকবেন সমরেশ মজুমদার!

নিন্মোক্ত লেখাটি লেখক, সাংবাদিক মনজুরুল হক স্বল্প সময়ে সমরেশ মজুমদারের সাহিত্যের একটি তুলনামূলক খণ্ডন ও বিশ্লেষণ করেছেন। লেখাটিকে যুক্তি দিয়ে দীর্ঘ পরিক্রমণে আনা যায়। কিন্তু বরাবার পশ্চা..পদ বাঙালি আদারস পারস্পেশন না মেনে নেয়ার দলেই থেকে যাবে। দেখা যাবে চাপাতি, দা, কুড়োল নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। 

তাই অল্পে তুষ্ট থাকো বোকারা। -বোকা 

পাঠ সতর্কতা: লেখাটি বিশেষভাবে নকশালপন্থী কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের জন্য

 
সমরেশ মজুমদার গত হয়েছেন। যে কোনো মৃত্যু বেদনাদায়ক। সমরেশ একজন শক্তিশালী লেখক ছিলেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে যেভাবে শোক-ভক্তি-শ্রদ্ধার বান ডেকেছে ততটা মহান সাহিত্যিক তিনি ছিলেন না। ক্রমানুসারে তিনি যে উপন্যাস-গল্প লিখেছেন—উজান, কালপুরুষ, কালবেলা, সাতকাহন, উত্তরাধিকার, গর্ভধারিণী, সেসবে তিনি নকশালবাড়ি রাজনীতির বাজারকাটতি উপাখ্যান ব্যবহার করেছেন। সময়ের নিরীখে বাজারে সাহিত্য বিকোনোর জনপ্রিয় কন্টেন্ট ছিল নকশালবাড়ি। কিন্তু কেন? নকশালবাড়িকেই কেন উপজীব্য করতে হলো?
▪️
যে শিল্প-সাহিত্যকে আমরা ‘বাজারি’ বলে চিহ্নিত করি সেই বাজারি পত্র-পত্রিকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীসাহিত্যিকেরা এখনও নকশালপন্থীদের প্রতি সহানুভূতির বন্যা বইয়ে দেন। এখনও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘পূর্ব পশ্চিম’ লিখতে গিয়ে চারু মজুমদারকে চরিত্র হিসাবে আনেন……সমরেশ মজুমদারও ব্যাতিক্রম থাকতে পারেননি। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে নকশালবাড়ির রাজনীতিকে উপজীব্য করেছিলেন। তার উপন্যাসে আমরা দেখি— বিপ্লবীরা খাম-খেয়ালি, বিপ্লবীরা ইরেস্পন্সিবেল, বিপ্লবের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক সেবা দাসীর! কেন এই রোমান্টিসিজম? তিন বিপ্লবের কথার মধ্যেই প্রেমের উপাখ্যান হাজির করতেন। তার বর্ণিত ‘বিপ্লব’ প্রতিস্থাপন হয়ে যেত প্রেমের রোম্যান্টিকতায়।
▪️
তিনি তো নকশালপন্থী ছিলেন না। তার পরও তাঁকে কেন নকশালবাড়ি রাজনীতিকে আশ্রয় বানাতে হলো? কারণ তিনি চালাক-চতুর মানুষ। বুঝেছিলেন; এ জমানার প্রধান ঝোঁক বিপ্লব। আর সেটা অবশ্যই ভারতবর্ষকে নাড়িয়ে দেওয়া নকশালপন্থী বিপ্লব। তাই দ্রুত জনপ্রিয়তার শিখরে উঠবার জন্য তাঁকে নকশালপন্থাকে সাহিত্যে মালমশলা করতে হয়েছে। যেমনটি করেছিলেন কবীর সুমন, মিঠুন চক্রবর্তী।
▪️
সমরেশদের সময়ের সাহিত্যের অলিন্দে, দেরাজে, খড়খড়িতে থরে থরে কন্টেন্ট সাজানো। সেই সব কন্টেন্ট ধরে ধরে সাহিত্যের ধূমকেতু দিগবিদিগ ছোটে। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে কখনো দুদণ্ড বিশ্রামের জন্য কোনো কৃষকের আঙ্গিনায় ঠাঁই নেয়। এরই মধ্যে সাতকাহনের দিপাবলী আর কালবেলার মাধবীলতা কিংবা একজন অসম্ভব প্রিয় চরিত্র অনিমেষ প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে ওঠেন। সেটুকুই কৃষকের সাথে নৈকট্য এই ফাঁপা বুর্জোয়া এবং সংশোধনবাদী সাহিত্যের। এই সাহিত্যে ঘুরে ফিরে মধ্যবিত্ত আবেগ, প্রেম ভালোবাসা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, ইহকাল-পরকালের হিসেব-নিকেশ, স্নেহ-মমতা, ভক্তি-শ্রদ্ধা, বন্ধু-বাৎসল্য, পরকালের ভীতি, ইহকালের কামাই-রুজি, ষড়যন্ত্র-শঠতা সবই উঠে আসে।
▪️
নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রতি জনমানসে এখনও প্রভাব আছে বলেই এইসব সাহিত্যি ব্যবসায়ীরা তাদের জনপ্রিয়তা বজায় রাখার চজন্যই নকশালপন্থার ছদ্ম সমর্থক সাজে। তাদের সাহিত্য ব্যবসায় নকশালবাদ আজও সর্বাধিক বিক্রিত ‘পণ্য’। কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধে নকশালবাড়ির রাজনীতি আজও বিপুল প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্য তো আজও নকশালবাড়ির নষ্টালজিয়ার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সেসব ব্যবহার মুনসিয়ানা দেখানোর পুরোধা ছিলেন সমরেশ মজুমদার।
▪️
এখন প্রশ্ন উঠবে—তাহলে বিপ্লবী সাহিত্য কী? বিপ্লবী সাহিত্য জনগণের বিপ্লবী আকাঙ্খা আর বিপ্লবী স্বপ্ন সারথী। বিপ্লবী যুদ্ধের আবেগে ভরা আক্রমণের অস্ত্র। জনগণের হাতে আক্রমনোদ্ধত মতাদর্শীক বর্ষাফলা। বিপ্লবী সাহিত্য নিরাভরণ সশস্ত্র সাহিত্য। বিপ্লবী সাহিত্য জনগণের চূড়ান্ত বিপ্লবী সত্যকেই প্রকাশ করে। বিপ্লবী সাহিত্য শ্রেণী সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপের নিবিড়তম ভাষ্য। প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থায় এই সত্য নিহিত থাকে। শ্রেণী সংগ্রামের আগুণে পোড়া সেই সশস্ত্র সাহিত্যই নিপীড়িত মানুষের প্রাণের স্পন্ধন।
▪️
আজকের দুনিয়ার মূল সুর বিপ্লব। আমরা কার্যতঃ বিশ্ববিপ্লবের মধ্যে, আরো সঠিক করে বললে জনযুদ্ধের মধ্যে বাস করছি। এ কারণে আমাদের লেখালিখি জনযুদ্ধবিরোধী বা বিশ্ববিপ্লববিরোধী হতে পারেনা। একটি কালপুরুষ, কালবেলা, সাতকাহন, উত্তরাধিকার, গর্ভধারিণী কৃষকের বিপ্লবাকাঙ্খার প্রতিভূ হতে পারেনি।
▪️
যদি এই বিশ্ববিপ্লবের সুরের কথাই ধরি তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে হবে বাংলা সাহিত্য সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিপ্লবকে আগে কখনো ধারণ করেনি, এখনো করেনা। এখন থেকে অর্ধ শতাব্দীরও আগে যখন ভারতবর্ষে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী চিন্তার অবতারণা হয়েছে, বিশ্ব পরিসরে রুশ বিপ্লবের মত দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লব সংঘঠিত হয়েছে, তখন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর ইত্যাদিরা ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’, অপরাজিত কিংবা ‘কবি’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, নাগিনী কন্যার কাহিনী লিখে কি করে বিখ্যাত হন? কোথাও কি কৃষক শ্রমিকের কথা এরা লিখলেন? ভারতবর্ষের ইতিহাস তো কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস। এরা কেন সেই মূল ধারায় রইলেন না? ব্রিটিশ ঔরসজাত চিন্তা- চেতনা যাদের মগজে গ্রথিত, খেতাব, অর্থ প্রতিপত্তি যাদের আবিষ্ট করে রেখেছিল তারা কি করে ভারতের কৃষক-শ্রমিকের কথা লিখবে?
▪️
কারও কারও মনে গতে পারে একেবারে গড় পড়তা সব্বাইকে প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে দেয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত? সেক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল আর প্রগতিশীল সাহিত্যের ব্যবচ্ছেদটা আগে জানা দরকার। দেখা দরকার সত্যিকারের বিপ্লবী সাহিত্য কি? বিপ্লবী সাহিত্য বিপ্লবী যুদ্ধের ব্যাপারি। বিপ্লবী সাহিত্য বিপ্লবী শ্রেণী হিংসার স্বাক্ষী। বিপ্লবী সাহিত্য বিপ্লবী ক্রোধ ও ঘটনার স্বরলিপি। ফলে সাহিত্যে জনগণের এই আকাঙ্খা মূর্ত না হলে জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের দিকনির্দেশনা না থাকলে সেই সাহিত্যকে কোনো ভাবেও সর্বহারা শ্রেণীর সাহিত্য বলা যাবেনা। সাহিত্য শিল্পের কাজ হল বাস্তবের স্বরূপ প্রকাশ করা। এখানে সমরেশবাবুদের মত জনপ্রিয় কন্টেন্টআশ্রয়ী সাহিত্য দালাল সুবিধাবাদী বুর্জোয়া আর মধ্যশ্রেণীর তল্পি বহন করেই চলে। আর তার অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়ায় নৈরাশ্যবাদ প্রচার করা। এদের সাহিত্যে হাত ধরে উঠে আসে নর-নারীর আদেখলে প্রেম, ফুল, লতা-পাতা আর নারীর শরীরী বিবরণ।
▪️
সাহিত্যের কাজ হল বাস্তবের স্বরূপ প্রকাশ করা। জনপ্রিয় সাবজেক্টের প্রতি ঝোঁক সাহিত্যকে কখনো কখনো শক্তিশালীও করে। কখনো বা সাহিত্য এসব আবর্জনাসমেতই প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু চরম বিচ্ছিন্নবাদীতা যাকে আমরা অ্যালিয়েনেশন বলে থাকি তার প্রভাবে এই সাহিত্য কোনোভাবেও কৃষক-শ্রমিকের প্রতিভু হয়ে উঠে পারেনা। এমনকি কৃষক-শ্রমিকের সুখ-দুঃখের ভাগিদারও হতে পারেনা। সেখানে কৃষক-শ্রমিককে উজ্জীবিত করা, আন্দোলনমুখি করা, সচেতন করা, সশস্ত্র করা তো দূরের বিষয়! এইসব সীমাবদ্ধতা নিয়েই সমরেশ মজুমদার এ সময়ের ভীষণ জনপ্রিয় সাহিত্যিক। কপালে চন্দন-তিলক চর্চিত সমরেশের মৃত্যুতে রোম্যান্টিসিজমে ভোগা বাঙালি মধ্যবিত্ত সাহিত্য রসানুরাগীরা একজন নিবেদিতপ্রাণ ন্যারেটর হারাল, যার অন্যতম কাজ ছিল কৃষক-শ্রমিকের মুক্তির রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরের নিরাপত্তাবলয়ে বসবাস করে কৃষকে-শ্রমিকের মুক্তির রাজনীতি—নকশালপন্থাকে এনক্যাশ করা।
▪️
মে ৮, ২০২৩

বোকা মনজুরুল হকের এই লেখাটি কোনো কর্তন যোজন-বিয়োজন ছাড়াই প্রকাশ করেছে। পাঠ প্রতিক্রিয়া যারা প্রকাশ করতে চান তারা সরাসরি বোকার মন্তব্য ঘরে লিখুন। মাথার উপর দিয়ে গেলে লেখাটি ইগনোর করুন। কিংবা আপনি প্রচন্ড রেগে গেলে হাঙ্গামা না করে যুক্তির নিরীখে আমার বক্তব্য পেশ করুন। পুনরায় জানাচ্ছি, লেখাটির একটি পাঠ সতর্কতা আগেই দেয়া ছিল তাই পাঠক হিসাবে আপনার রুচি নিয়ে বোকাদের আপত্তি নেই। 

ধন্যবাদ

One thought on “সমরেশ কেন তার সাহিত্যে নকশালবাড়ি রাজনীতিকে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *