সিঙ্গেল মাদার

Table of Contents

বাস্তবতার নিরিখে নিজের মানসপটে বসে থাকা কোনো ঘটনাকে নতুন আঙ্গিকে বিচার বিশ্লেষণ করে নতুন রূপ দেয়াই যেন গল্পকার জসিম উদ্দিনের লেখার শৈলী। ঘটনাটি হয়তো আপনার অচিন্তনীয়; তবুও যেন কতো চেনা। এইতো সেদিন আপনি যেন এমনই এক ঘটনার সম্মুখীন হলেন!
সিঙ্গেল মাদার তেমনই এক গল্প। যার কোনো সত্যানুসন্ধান প্রয়োজন হবেনা হয়তো; কিন্তু মনের কোথায় যেন একটা আবেশ তৈরি করে রাখে। সিঙ্গেল মাদারের গল্পের বর্ণনাভঙ্গি উচ্চতর সাহিত্য ভঙ্গিমার না হলেও প্রচলিত ভাষাভঙ্গিকে ধারণ করেছে। পাঠে মনোযোগ ছিটকে গেলেও ঘটনার বিস্তার আপনার মনোযোগকে আবার আবিষ্ট করবে।
“-শুনেন আমার হাতে সময় কম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ডেলিভারী হবে। পেটে বাচ্চা। আমার সাথে কেউ নেই। আমি গ্রিন সিগনাল না দেওয়া পর্যন্ত আপনি কোথাও যাবেন না। এখানে আশেপাশে থাকবেন। -কিন্তু, আমি তো আমার ফ্রেন্ডের কাছে এসেছি। একটু পরেই সে ফোন দিবে। তখন চলে যেতে হবে! -আপনার ফ্রেন্ডের সাথে নিশ্চয়ই তার হাজবেন্ড আছে। -তা আছে।”

সিঙ্গেল মাদার
গল্পকার জসিম উদ্দিন

সিঙ্গেল মাদার

আমার বাসাটা স্কয়ার হাসপাতাল থেকে খুব কাছাকা‌ছি।
আর সে জন্যই হয়‌তো স্কয়ার হাসপাতালে বন্ধুবান্ধব যেই আসে সেই ফোন লাগায়।
“‌দোস্ত স্কয়ারে আস‌ছি, তুই চলে আয়!”
‌যেহেতু অ‌ফিস শেষে বেশীর ভাগ সময় বাসায় বসে মুভি দে‌খি অথবা বই প‌ড়ি তাই কারো আবদার ফেলতে পারি না। 
এমনি এক‌দিন এক বন্ধু দম্প‌তি ফোন দিয়ে জানালো যে তারা স্কয়ারে চলে আসছে আ‌মি যেন আ‌সি। আমি তাড়াহুড়ো করে প্রস্তুত হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে চলে গেলাম। গিয়ে ফোন দিলাম- কিরে কই তোরা?
-আমাদের আসতে আরো দশমিনিট সময় লাগবে। রাস্তায় ভীষন জ্যাম। তুই একটু বস।
বাধ্য হয়ে আমি ৭ তলার ওয়েটিং ফ্লোরে বসে বসে মোবাইল গুতাচ্ছিলাম। ফেসবুক সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। এ যুগে অন্ততঃ কেউ কারো জন্য বোর ফিল করে না, যদি হাতে একটা মোবাইল থাকে।
আমি পেন্সিলের ছোট গল্পে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এমন সময় আমার সামনে এসে এক সিস্টার বললো-
আপনি কি শেখর সাহেব?
-জ্বি।
-আপনার ওয়াইফ আপনাকে ডাকছে!
-জ্বি?
-আপনার ওয়াইফ আপানাকে ডাকছে?
-জ্বি?
এত জ্বি জ্বি করছেন কেন? আমার কথা বুঝতাছেন না? ওই যে সামনে স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। ওটিতে যাওয়ার আগে কী জানি জরুরী কথা বলবে। তাড়াতাড়ি যান, শুনে আসেন।
আমি সামনে তাকালাম।
স্ট্রেচারে শুয়ে আছে একটা মেয়ে। সারা শরীর ঢাকা। ফর্সা ধবধবে মুখটা কেবল দেখা যাচ্ছে।
মেয়েটি হাত ইশারায় আমাকে ডাকলো। আমি গেলাম। পিছন পিছন নার্স মেয়েটিও গেলো।
মেয়েটি নার্সটিকে বললো- “সিস্টার, আমরা জরুরী দু-মিনিট কথা বলবো, আপনি দু-মিনিট অন্য দিকে যান প্লিজ।”
নার্সটি চলে গেলো। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। মেয়েটির পেট উঁচু থেকে আন্দাজ হলো মেয়েটি গর্ভবতী। সম্ভবত সিজার হবে। ছিমছাম গড়নের মেয়েটি অস্বাভাবিক রকমের সুন্দরী।
-জ্বি।
-শুনেন! আমার হাতে সময় কম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ডেলিভারী হবে। পেটে বাচ্চা। আমার সাথে কেউ নেই। আমি গ্রিন সিগনাল না দেওয়া পর্যন্ত আপনি কোথাও যাবেন না। এখানে আশেপাশে থাকবেন।
-কিন্তু, আমি তো আমার ফ্রেন্ডের কাছে এসেছি। একটু পরেই সে ফোন দিবে। তখন চলে যেতে হবে!
-আপনার ফ্রেন্ডের সাথে নিশ্চয় তার হাজবেন্ড আছে।
-তা আছে।
 -তার টেককেয়ার করার লোক আছে। কিন্তু আমার সাথে কেউ নেই। যে কোন প্রয়োজন পড়তে পারে। কোনটা জরুরী? আপনার ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করা নাকি আমার পাশে থাকা? 
-“কিন্তু আপনার হাজবেন্ড কোথায়?” আমি বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-আমার হাজবেন্ড নেই!
-মানে?
-নেই মানে, নেই।
-এখন আবার জিজ্ঞেস করবেন নিশ্চয় “হাজবেন্ড নেই তো বাচ্চা কেমনে আসলো”
আমি এমনভাবে মেয়েটির দিকে তাকালাম যে এটা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং জিজ্ঞেস করার মতো কোশ্চেন।
-কিন্তু আমার পেইন হচ্ছে এবং এই মুহূ্ের্ত কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব না। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর সময়মতো পাবেন। আপাতত আমাকে হেল্প করেন।
-কিন্তু আপনি আমাকে চিনেন কিভাবে? এত লোক থাকতে আমাকে চুজ করলেন কেন?
মেয়েটি এবার হতাশ হওয়ার ভঙ্গি করলো। বোঝা গেলো এ প্রশ্ন সে আশা করেনি।
-“আপনাকে আমি গত পাঁচ বছর ধরে ফলো করি। আপনার সব লেখা পড়ি। আপ‌নি যে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসেন সেইটাও আমি জানি। সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে আপনাকে আমার সামনে এনে দিয়েছে।”

প্রশংসা সবারই ভালো লাগে। আর পৃথিবীর সকল লেখকই তার লেখার ভক্ত পেলে খুশি হয়। আমিও খুশি হলাম। মুখ থেকে বিরক্তিকর আভা কিছুটা কমলো। আর মেয়েটি সে সুযোগ নিলো।
-আমি, ঈশিতা জাহান। আপাতত এটুকই জানেন। সিস্টার বা ডক্টর যা বলে সবকিছুতে সায় দিবেন। কোনটাতেই না বলবেন না কিংবা আমতা আমতা করবেন না। মনে থাকে যেন।
-ও হ্যাঁ! টাকা-পয়সার চিন্তা করতে হবে না। সব পেমেন্ট আমি দেব। আপনার এক টাকাও খরচ হবে না। আমি এও জানি আপনি অভাবী মানুষ!
বলতে বলতে মেয়েটি একটা দুষ্ট হাসি দিলো।

যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহেরাতেও মেয়েটির হাসি বেশ সুন্দর লাগলো। এতক্ষণে দু-মিনিট হয়ে গেছে। নার্স এসে স্ট্রেচার ধরে মেয়েটিকে ওটিতে নিয়ে গেলো।

আমি একটা ঘোর লাগা ভাব নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন।
এমন সময় মাইকে এনাউন্স করলো- ঈশিতা জাহানের কে আছেন? দয়া করে ও‌টির সামনে আসেন।
আমি এগিয়ে গেলাম।
আমাকে রোগীর গার্ডিয়ান হিসেবে স্বাক্ষর করতে বলা হলো।
রোগীর সাথে সম্পর্কের জায়গায় আগেই হাজবেন্ড লেখা আছে। ঈশিতা জাহান নিজেই লিখে দিছে।
মেয়েটির হাতের লেখা সুন্দর।
আমি সাইন করে এসে চেয়ারে বসেছি। ইতোমধ্যে বন্ধু চলে এসেছে। দু-বারের মতো ফোন দিয়েছে। আমি টের পাইনি। আমি মোবাইলের সুইচ অফ করে দিলাম।
এক ঘন্টা, দু ঘন্টা, তিন ঘন্টা চলে গেলো। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। দু্-বার উঠেছিলাম।
এক বার কফি আনতে। আরেকবার ওয়াশরুমে যেতে।
চার ঘন্টার মাথায় আমার কাছে ওই নার্স আসলো, একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো- “অভিনন্দন! আপনি পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছেন!”
আমি কি বলবো বুঝতেছিলাম না। কিন্তু খুশী হওয়ার অভিনয় না করলে সন্দেহ করতে পারে। তাই খুশী হওয়ার ভাব নিয়ে বললাম- “থ্যাংক ইউ।”
আরো ঘন্টা তিনেক চলে গেলো। ঘন্টা তিনেক পরে মেয়েটিকে কেবিনে দিলো। কেবিনে যাওয়ার পথে ঈ‌শিতা আমাকে ইশারায় ডাকলো। পিছন পিছন কেবিনে গেলাম। ঈ‌শিতার পাশে ফুটফুটে এক বাচ্চা। আ‌মি অপ‌লক দৃষ্টিতে অসম্ভব সুন্দর বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। 
ঈ‌শিতা একবার বাচ্চা‌টিকে দেখে একটা তৃ‌প্তির হা‌সি দিলো।
হা‌সি দিয়ে আমার দিকে ফিরলো, ফিরে বললো-
“আজকে আপ‌নি যেতে পারেন। আজকের মতো আপনার ছু‌টি। হয়তো আমার এখানে আরো দু‌-দিন থাকতে হবে। চাইলে আপ‌নি পরে এসে আমাকে দেখে যেতে পারেন। আর আমার জীবনের গল্পটা শোনার ইচ্ছেও হয়তো আপনার আছে। পরে যেদিন আসবেন সে‌দিন না হয় গল্পটা বলবো।” 
ঈ‌শিতার কাছ বিদায় নিয়ে ফেরার পথে মোবাইল অন করলাম।
রাত তিনটে বাজে। 

আ‌মি ঘুম কাতুরে মানুষ। ঘুম পেলে পৃ‌থিবীর কোন চিন্তা মাথায় কাজ করে না। 

কোনমতে বুয়ার দুপুরে রান্না ক‌রা বাসী খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
সাইলেন্ট করা মোবাইল আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো না।
বলে রাখা ভালো আমার কোন প্রেমিকা বা বউ নেই।
ঘুমানোর সময় কারো ফোন, কা‌উকে অপেক্ষায় রাখা কিংবা কাউকে কৈ‌ফিয়ত দেওয়ার প‌্যারা কাজ করে না। 
প্রতি‌দিন এক দু বার খোঁজ নেয় আমার মা আর অ‌ফিসের বস।
দুজনেই যেহেতু আমাকে বেশ ভালো করে জানে তাই ছু‌টির দিনে দু-একবারের বেশী ফোন তারা দেয় না।
বুয়াকে বাসার চা‌বি দেওয়া আছে।
ঘরে ঢুকে সব কাজ শেষে লক লা‌গিয়ে চলে যায়।
আমাকে ডিস্টার্ব করে না।
সাউন্ড স্লিপ শেষে আমার ঘুম ভাঙ‌লো ওই‌দিন দুপুর দুইটায়।
দীর্ঘ দশ ঘন্টার ঘুমে আমি বেশ ফুরফুরে।
ফ্রেশ হয়ে ডাই‌নিং টে‌বিলে গেলাম। 
ডাই‌নিং টে‌বিল খা‌লি। কোন খাবার নেই। 
তারমানে সকালে বা দুপুরে বুয়া  আসেনি।
অথবা চা‌বি ভুলে বাসায় ফেলে রেখে এসে কয়েকবার ক‌লিং বেল চাপছে।
সাড়া না পেয়ে চলে গেছে।  
বাইরে বের হলাম। 
সপ্ত‌ডিঙায় লাঞ্চ, চা সেরে পুনরায় বাসায় ফি‌রতে ফিরতে তিনটে বাজলো।
ড্রয়িং রুমে ঢুকলাম দেশের হাল খবর সম্প‌র্কে একটু ধারনা নেওয়ার জন‌্য।
টি‌ভির রিমোট খোঁজার সময় সোফায় চেতন ভগতের হাফ গার্লফ্রেন্ড বইটা চোখে পড়লো। বই‌টি খোলা অবস্থায় উল্টো করে সোফায় রাখা।
গতকাল বন্ধু দম্প‌তির ফোন পাওয়ার পূর্বে ওটাই পড়ছিলাম।
হাফ গার্লফ্রেন্ডের নায়ক মাধব হন্য হয়ে আমেরিকার আনাচে কানাচে রিয়াকে খুঁজছে। খুঁজে পেল কিনা জানা দরকার।
পাতা ওল্টাতে থাকলাম। খুব বেশী পাতা বাকী নেই। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পড়া শেষ হয়ে গেলো। অবশেষে রিয়াকে মাধব খুঁজে পেয়েছে। মাধবের স্ব‌স্তি, পাঠক হিসেবে আমারও স্ব‌স্তি।
মাধব-রিয়ার চমৎকার এন্ডিং আমাকে গতকালের স্কয়ার হাসপাতালের অসমাপ্ত এন্ডিং-এর কথা মনে করিয়ে দিলো।
কেমন আছে ওই সিঙ্গেল মাদার? কেমন আছে ওর ছেলে? একটা ফোনও তো আ‌মি দেই‌নি। সে দিছে কিনা তাও জা‌নি না।
জানার জন‌্য মোবাইলের কল লিস্ট চেক করলাম।
মনে পড়লো ওকে তো আ‌মি নাম্বার দেই‌নি! ফোন দেবে কেমনে?
তাহলে আমার এখন কি করা উ‌চিত?
সে তো আমাকে যেতে বলেছে!
আমার কি যাওয়া উ‌চিত?
না গেলে ওর জীবনের গল্পটাও তো শোনা যাবে না!
ওর বাচ্চার বাবা কে? এদেশে কি স্পার্ম ক্রয়-‌বিক্রয় / ডোনেশান সিস্টেম চা‌লু হয়েছে?
হওয়ার কথা না। য‌দি হতো তবে ঈ‌শিতা আমাকে হাজবেন্ড হিসেবে প‌রিচয় করাতো না। ক‌লিগ, কা‌জিন, গার্ডিয়ান কিছু একটা বলতো।
তাহলে?

প্রাক্তন শিশু অভিনেতা হিসাবে আইকার্লি এবং স্যাম আর ক্যাট স্টার জেনেট ম্যাককার্ডির হৃদয়বিদারক এক হাস্যকর স্মৃতিকথার সম্ভার ‘আই অ্যাম গ্ল্যাড মাই মম ডাইড’। খাওয়া নিয়ে কারো ডিজর্ডার হতে পারে এই বই পড়লে সেটিও জানা যাবে। আর নেশা কী জিনিসরে বাপ এইটা পইড়া দেইখ্যা ক রে মমিন। 

বই না যা তা! বাংলার হুদাই জনপ্রিয় বোধ বুদ্ধির বাইরে কপটচারী সাহিত্যিকদের যে সব নির্দশন আছে তার চেয়ে কম কিছু না। 

যদিও বই এখন মার্কেটিংয়ের উপ্রে আছে, প্রচারের নান্দনিক কৌশলের উপ্রে আছে; তাই এইসব উজবুক জিনিস আম-পাবলিক খাইতে বাধ্য! ব্যাপার হইলো বইয়ের বর্ণনাভঙ্গি।

মাথায় প‌্যারা দিচ্ছে বিষয়টা। মাথা থেকে বের করতে হবে।
আমি পান্থপ‌থ থেকে এক গুচ্ছ ফুল আর স্বপ্ন সুপা‌র শপ থেকে একটা কিডস গিফট বক্স নিয়ে স্কয়ারে গেলাম।
ঢুকবো কিনা ইতস্তত কর‌ছি। কয়েকবার নক করলাম।
কোন সাড়া নেই।
মনে পড়লো সাড়া দেওয়ার তো কেউ নেই। ও‌নি তো এটেন্ডডেন্টহীন।
আমি সামান‌্য একটু দরজাটা ফাঁক করলাম যাতে ভিতর থেকে সাউন্ড আসে।
-‌ভিতরে আসুন শেখর সাহেব।
আ‌মি ঢুকলাম।
“কীভাবে বুঝলেন যে আ‌মিই এসেছি?
-আপ‌নি বাদে আর কেউ তো জানেনা যে আমি এখানে এড‌মিট আ‌ছি।
তাছাড়া নার্সরা ঢুকলে অনুম‌তির অপেক্ষা করেনা। একবার নক করে সাথে সাথে ঢুকে যায়।
“কনগ্রেচুলেশনস ফর বি‌য়িং মাদার। বেস্ট উইশেস ফর ইউ এন্ড ইউর চাইল্ড!”
আ‌মি ফুল আর গিফট বক্সটা পাশের টে‌বিলে রাখতে রাখতে বললাম।
-‌থ‌্যাংকস ফর ইউর উইশেস। তবে গিফট দেওয়া বা আমার খবর নেওয়ার‌ জন‌্য নিশ্চয় আপ‌নি আসেননি! 
-সেটা খুব স্বাভা‌বিক। ইমোশনাল ব্ল‌্যাক মেইল করে গতকাল থাকতে বাধ‌্য করা বাদে আপনার প্রতি টান তৈ‌রি হওয়ার মতো কোন কাজ তো আপ‌নি করেননি!
-আজকে আপনাকে পুনরায় আনাটাও তো ব্লাকমেইল!
-‌জ্বি, আপ‌নি বু‌দ্ধিমতি। আমার ধারনা আপ‌নি লেখালেখিও করেন। লেখার প্লট দিয়ে যে লেখককে ব্লাকমেইল করা যায় এটা লেখক না হলে জানার কথা না।
ঈ‌শিতা বু‌দ্ধিদীপ্ত হা‌সি দিলো। তবে হা‌সিতে ক্লা‌ন্তির ছাপ স্পষ্ট।
এসময় তাকে তার জীবনের কোন ঘটনা বলতে বাধ‌্য করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পার‌ছিলাম না। তারপরও আগ্রহ দমাতে পারলাম না।
-আপনার বাচ্চার বাবা‌ কোথায়?
-আই কিলড হিম।
ঈ‌শিতার নি‌র্লিপ্ত উত্তর। এতই শান্ত যে ওটার মাঝে কোন প্রায়‌শ্চিত্ত বা অনুতাপ নেই।
-‌হোয়াই?
-‌সে অনেক বড় কা‌হিনী। সেটি জানতে হলে আপনাকে সময় দিতে হবে। বাচ্চাকে ফি‌ডিং করানোর সময় হয়েছে। আপ‌নি বরং এক কাপ ক‌ফি খেয়ে আসুন এবং আমার জন‌্যও এক কাপ ক‌ফি নিয়ে আসুন। আ‌মি এই ফাঁকে বে‌বিকে ফি‌ডিং করিয়ে শেষ ক‌রি।
আ‌মি থ্রিলার সিনেমার মতো টান টান উত্তেজনা ফিল কর‌ছি। এক সেকেন্ড সময় এক ঘন্টা মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। সদ‌্য প্রসুত মায়ের কাছে তার সন্তানের কেয়ার সবার আগে। এটুকু সময় তাকে আমার দিতেই হবে।
স্কয়ার হাসপাতালের প্রত্যেক ফ্লোরে ফ্লোরে ক‌ফির ব‌্যবস্থা আছে। মাথায় টেনশান ঢুকলে আমার সি‌গারেটের পিপাসা পায়। ক‌ফির চেয়ে আমার এখন সিগারেট খাওয়া জরুরী। আ‌মি সোজা নীচে নেমে গেলাম। একটা সি‌গারেট খেয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে দু কাপ ক‌ফি নিলাম। ক‌ফি নিয়ে কে‌বিনে ঢুকলাম।
ঈ‌শিতা বাচ্চাকে ফি‌ডিং করানো শেষ করেছে। ক‌ফিটা হাতে দিলাম।
ক‌ফিতে চুমুক দিতে দিতে ঈ‌শিতা শুরু করলো-
“আ‌মি সম্ভ্রান্ত প‌রিবারে মেয়ে। আমার বাবা বি‌শিষ্ট ব‌্যবসায়ী। আমার বয়স যখন বারো তখনই আমার মা মারা যায়। আমার ধারনা আমার মা মারা যায়নি। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। উচ্চ‌বিত্তের প‌রিবারগুলোতে অনেক  কিছু ঘটে, যা নিম্ন‌বিত্ত বা মধ‌্যবিত্তের মানুষজন জানে না। অনেক সময় আইনও তাদের আশেপাশে ঘে‌ঁষে না। মা মারা যাবার দশ‌দিনের মাথায় আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করে। বয়স আমার বাবার অর্ধেক। অসম্ভব রুপবতী। তবে বিয়েটা দশ‌দিন আগে নয় দশ মাস আগেও হতে পারে। 
যাক সেসব কথা।
আমাকে দেখাশোনার দা‌য়িত্ব পড়ে দুজন কাজের বুয়ার উপর। টাকা পয়সার কোন‌ সমস‌্যা নেই। প্রতি‌দিন বাসার ম্যানেজার আমাকে টাকা দিয়ে যায়। আমার যা প্রয়োজন পড়ে আ‌মি বুয়াদের দিয়ে আনাই। প্রথম প্রথম মায়ের জন‌্য খারাপ লাগলেও পরে অভ‌্যস্ত হয়ে প‌ড়ি। আ‌মি নিজের জীবনের জন‌্য নিজস্ব একটা গ‌ন্ডি তৈ‌রি করতে থা‌কি।
আ‌মি ভিকারুন‌ন্নেসায় চান্স পাই। আমাকে পড়ানোর জন‌্য এক হাউজ টিউটর রাখা হয়। তি‌নি ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের ছাত্র। পজেটিভভাবে বললে আমার জীবনের টা‌র্নিং গাইড ওই হাউজ টিউটর। নেগেটিভভাবে বললে আমার জীবনের এই প‌রিণ‌তির জন‌্য দায়ী তি‌নি।
উনি আমার জীবনে না আসলে আমার চারপাশের সবার মতো হয়তো বিলাসী জীবন হতো আমার। আড্ডা, পা‌র্টি, ক্লাব, ফু‌র্তি এসব নিয়েই কেটে যেতো জীবন। প্রেম কিংবা ফি‌জিক‌্যাল রিলেশনে কোন জড়তা থাকতো না।
কিন্তু ওই টিচার আমার জীবন দর্শন বদলে দেয়। আমাকে মান‌বিক, প‌রিচ্ছন্ন, নলেজেবল জীবনে উৎসা‌হিত করে। বই, সিনেমা, প্রকৃ‌তি, মানবতা এসবে আকৃষ্ট করে। আ‌মি এই টিচারের প্রেরণায় তথাক‌থিত আনন্দময় জীবন থেকে বে‌রিয়ে আ‌সি। 
সম্ভবত আ‌মি মে‌ধাবীও ছিলাম। অল্প একাডেমিক পড়াতেই ভালো রেজাল্ট করতাম। একাডেমিক বইয়ে খুব বেশী সময় দিতে হয়‌নি আমাকে।
ইন্টার‌মিডিয়েট পাশ করার আগেই আ‌মি শমরেশ, শীর্ষেন্দু, সু‌নীল, জাফর ইকবাল, হুমায়ুন আহমেদের প্রায় সব বই পড়ে শেষ ক‌রি। অনার্স প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে আ‌মি রবীন্দ্র, নজরুলও শেষ ক‌রি। 
সা‌হিত্যে নেশা ধরে যায়। ভালো লেখকদেরকে যাদুকর মনে হতো আমার। ওদের শব্দের সাথে শব্দ মেলানোর কৌশল, চারপাশকে দেখার দৃ‌ষ্টিভঙ্গী, গল্পের প্লট তৈ‌রির দক্ষতা, সব‌কিছ‌ু আমাকে বিমোহিত ক‌রতো। সমাজের অদেখা ভুবন আ‌মি ওদের চোখেই দেখতে থা‌কি।
আর এভাবেই ক্রিয়ে‌টিভ মানুষদের ব‌্যক্তিগত জীবনের প্রতিও আমার আগ্রহ তৈ‌রি হয়। আমি মৃত‌ লেখকদের জীবন‌ী প‌ড়া শুরু ক‌রি এবং জী‌বিত ভালো লেখকদের ফেসবুকে, টুইটারে ফলো করতে থা‌কি।
মাঝে মাঝে নিজেকে ওদের জায়গায় কল্পনা করি। একজন ভালো মানের লেখক হওয়ার স্বপ্ন আমার ভিতর উঁকি দিতে থাকে।
এরই মাঝে বর্তমান সময়কার একজন জন‌প্রিয় লেখক আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়। ভার্চুয়াল ও রিয়েল দুই জগতেই সে বেশ জন‌প্রিয়। তার লেখালেখি, ফেসবুক ব‌্যক্তিত্ব আমাকে আকৃষ্ট করে। তার সাথে আমার মেসেঞ্জারে কথাবার্তা বাড়তে থাকে। সে মাঝে মাঝে তার বিভিন্ন লেখা থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতি আমাকে মেসেঞ্জারে দিতো। অধিকাংশই জীবন ঘনিষ্ঠ এবং পরিচ্ছন্ন। আমি মুগ্ধ হতাম। দিন দিন মুগ্ধতা বাড়তে থাকে।
এক‌দিন সে আমার সাথে কফি খাওয়ার অফার দেয়।
ভালো লেখকরা সমাজের দর্পন। অসংখ‌্য মানুষ তাদের জীবন দর্শন ফলো করে। তাদের লেখার মাঝে নিজের আদর্শ খুঁজে। গল্পের চরিত্রের মতো হতে চায়।
ভালো চ‌রিত্রের স্রষ্টার ভিতর খারাপ কিছু থাকতে পারে সে রকমটা আমার ভাবনায় তখনও আসেনি।
আ‌মি গুলশানের এ‌ক‌টি রেস্ট্রুরেন্টে তার সাথে দেখা ক‌রি।
তার চেহারায় একটা ইন্টেলেকচুয়াল ভাব আছে। ততটা সুদর্শন না হলেও খারাপ না। আ‌মি সেপিওসেক্সুয়াল। চেহারার নয় তার মেধার প্রেমে প‌ড়ি।
ওর মি‌ষ্টি কথার যাদুতে আ‌মি পরাস্ত হতে থাকি। ওর প্রতি একটা মোহ আমার কাজ করতে থাকে। হয়তো সে আমার এ দূর্বলতাটা ধরতে পেরেছিলো। সে আমাকে প্রেম নিবেদন করে। আ‌মি না ক‌রি‌নি। তবে আ‌মি আমার জীবন দর্শন তাকে জা‌নিয়ে দেই। জা‌নিয়ে দেই যে আ‌মি প‌রিচ্ছন্ন, সুস্থ জীবনে বিশ্বাসী।
সে তাতে কোন সমস‌্যা দেখছে না বলে সায় দেয়।
আমাদের যোগাযোগ চ‌লতে থাকে। 
গত বছরের আগস্টের বারো তারিখের ঘটনা। সে‌দিন তার বার্থডে ছিলো। বার্থডেতে আমাকে দাওয়াত দেয়। বলে যে তার বাসায় জন্ম‌দিনের পা‌র্টি হবে, আত্নীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেকেই থাকবে। আ‌মি যেন যাই।
আ‌মি না করার ক‌োন কা‌রণ খুঁজে পাইনি।
আ‌মি তার প্রিয় কালারের শা‌ড়ি প‌রে, জন্ম‌দিনের একটা ভালো গিফট কিনে তার বাসায় যাই। বাসা বনানীতে। আ‌মার বাসার কাছাকা‌ছি। 
বাসায় গিয়ে একটু ধাক্কা খাই। বাসা পুরো খা‌লি। জিজ্ঞেস করলে বলে যে বাকীরা শীঘ্রই চলে আসবে। 
আমরা গল্প করতে থা‌কি। কিন্তু আজকে ওর গল্পের ধরন একটু অস্বাভা‌বিক ঠেকে। অনেকটা এডাল্ট টক। এগুলোতে আ‌মি অভ‌্যস্ত নই।
আ‌মি দু-একবার কথা অন‌্যদিকে ঘুরাতে চাই। কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে ড্রিংকস বের করে আমাকে অফার করে। আ‌মি স্পষ্ট না ক‌রি।
“আধু‌নিক প‌রিবারের শি‌ক্ষিত মেয়ে অথচ ড্রিংকস করো না, এটা হয়? আমার স্পেশাল ডেটা তোমাকে নিয়ে আ‌মি একটু স্পেশালভাবে সেলিব্রেট করতে চাই। কিন্তু তু‌মি তো সাপোর্ট দিচ্ছো না?” সে সে বলে।
আমি ওর ই‌ঙ্গিতটা ধরতে পা‌রি। 
“‌তোমার প্রিয় রংয়ের শা‌ড়ি পরে তোমার জন্ম‌দিনে আসাটা, তোমাকে সময় দেওয়াটা কি স্পেশাল কিছু নয়? এর চেয়ে বেশী কিছু য‌দি তোমার প্রত‌্যাশা থাকে তাহলে স‌রি। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আ‌মি চললাম।”
এই বলে আ‌মি উঠে যেতে উদ্ধত হই।
কিন্তু সে হা‌ত ঝাপটে ধরে। আ‌মি কষে চড় ব‌সিয়ে দেই। কিন্তু তাতেও সে দমেনি। আমার উপর জোর করতে থাকে। আমি চিৎকার করতে গেলে মুখ চেপে ধরে। ধস্তাধ‌স্তির এক পর্যায়ে আ‌মি পরাস্ত হই।
আ‌মি ঘৃণ‌ায়, অপমানে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। বাইরের পাক প‌বিত্র চেহারার কারো ভিত‌রটা এতটা কুৎ‌সিত হয় আ‌মি ভারতে পা‌রি‌নি। লেখক তো পরে, যে পুরুষ একজন নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য দেয় না, যে নারীর মনের স্বাধীনতাকে মূল্য দেয় না, যে নারীর উপর জোর করে, শরীর দিতে বাধ্য করে সে মানুষ হয় কী করে??
আমার ঘৃণায় বমি আসতে থাকে। 
আমার ভিতরে চরম প্রতিশোধ স্পৃহা জাগে।
কিন্তু আমি জানি আমি শারীরিকভাবে দুর্বল। বল প্রয়োগে পেরে উঠার কোন সম্ভাবনা নেই। যা করার ধৈর্য্য ধরে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।
আমি নিজেকে গুছিয়ে বের হয়ে চলে আসি।
থানা-পুলিশ, পারিবারিক ইনভলভমেন্ট ইত‌্যা‌দি দীর্ঘতম ও বিব্রতকর প্রক্রিয়ায় যাওয়ার ধের্য্যটা আ‌মি ধরতে পা‌রি‌নি। যা করার আমি নিজে করবো বলে সংকল্প করি।
আমি ওর সম্পর্কে আরো খোঁজ খবর নিতে থাকি। ওর চরিত্রের কালো অধ্যায়টা আমার সামনে আসে। এরকম আরো অনেক নারীর জীবন সে নষ্ট করেছে। অনেকে তার জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় সপে দিয়েছে। অনেককে সে জোর করেছে। কিন্তু সমাজে নিজের অবস্থান / ভ‌বিষ‌্যতের কথা চিন্তা করে কেউ মুখ খোলেনি।
আমি সেরকম নই। আমি স্বাধীনচেতা এবং নিজের মতো জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত। পরে কি হবে সেটার ভাবনা আমার ভিতর কাজ করেনি।
ওইদিন চলে আসার পর সম্ভবত তার ভিতর একটা ভয় কাজ করে। আমি কি করি না করি এ নিয়ে তার সন্দেহ হয়। তাই সে সরি বলে। বলে এগুলো এ সমাজে খুব স্বাভাবিক বিষয়, এগুলো নিয়ে আমি যেন মাথা না ঘামাই। আর আ‌মি না চাইলে এরকমটি আর কোনোদিন হবে না বলেও সে প্রতিজ্ঞা করে। আ‌মি যেন পুনরায় সবকিছু স্বাভাবিক করে ফেলি।
আমি এ সুুযোগটাই কাজে লাগাই। সবকিছু মেনে নিয়েছি এমনতর অভিনয় করি। তার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে থাকি আর ভিতরে ভিতরে প্ল‌্যান কর‌তে থা‌কি।
সিঙ্গেল মাদার, বাংলা, কবিতা, গল্প

আমার প্ল্যান সম্পন্ন হলে ওকে আবার তার বাসায় মিলিত হওয়ার অফার করি। সে সানন্দে রাজি হয়।

আমি আমার ব্যাগে পূর্বের পরিকল্পনা মতো ডে‌বিল ব্রেথ পাওডার / স্কপোলামিন ড্রাগ, হাই পাওয়ারের স্লি‌পিং পিল এবং একটা ছুরি নেই।
সামান্য কিছু আলাপচারিতা শেষে ওকে ডে‌বিল ব্রেথ দিয়ে হিপনোটাইজ করি। তারপর যে মাত্রায় স্লি‌পিং পিল খেলে একজন সুস্থ সবল মানুষ মরে তার ডাবল মাত্রার স্লি‌পিং পিল তাকে খাইয়ে দিয়ে আ‌মি চলে আ‌সি।
দু‌দিন পর প‌ত্রিকায় তার মৃত‌্যুর নিউজ প‌ড়ি, নিউজের শিরোনামটা এরকম- “ঘুমের ওষুধ খেয়ে জন‌প্রিয় লেখকের আত্মহত্যা!”
এ পর্যন্ত বলে ঈ‌শিতা থামলো। বাচ্চা নড়েচড়ে উঠেছে, তাকে কাছে টানলো। বাচ্চাটির মায়াবী মুখটা স‌ত্যিই সুন্দর।
-ছুরিটা কেন নিয়েছিলেন সাথে??
-ছুরিটা ছিলো প্ল্যান বি এর অংশ। যদি ডেবিল ব্রেথে বশ না হতো, ঘুমের ওষুধ না খাওয়াতে পারতাম তাহলে ওটা ব্যবহার করতাম। 
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মেয়েটির সাহস ও দৃঢ়তা দুটোই আমাকে বেশ অবাক করলো।
-হোয়াইর ডিড ইউ ক‌্যা‌রি দিস বে‌বি?? হোয়াই ডি‌ডন্ট ইউ এবর্ট হিম?
-‌বিষয়টা এমন নয় যে ওর বাবাকে মারার পর তার প্রতি আমার দুর্বলতা বা ভালোবাসা তৈ‌রি হয়েছিলো। ওই প‌ারভার্ট, ছদ্দবেশী লেখকের প্রতি আমার কোন সহানুভূ‌তি কখনই কাজ করেনি। বাচ্চাটা ক‌্যা‌রি করেছি অন‌্য কারণে। ওই ঘটনার পর আমি আর কোন ধরনের সম্পর্কে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। তবে আমার ভিতরে জন্ম নেওয়া প্রাণটার প্রতি অন্যরকম একটা ফিলিংস কাজ করে। সম্ভবত মাতৃত্ব জেগে উঠে। অপরাধী ওই পারভার্ট হতে পারে। কিন্তু প্রাণটার তো কোন দোষ নেই। 
তাছাড়া মানুষজন বলে মা হতে না পারলে নাকি নারীর জীবনে পূর্ণতা আসে না। আমি যদি আর কোনদিন বিয়ে না করি তবে মাতৃত্বের স্বাদ আর আমি কোনদিন পাবো না। তাই ওকে রেখে দেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্তটা নেই এবং আ‌মি প‌রিবার থে‌কে বি‌চ্ছিন্ন হয়ে আলাদা বাসা নিয়ে তার পরিচর্যা করতে থাকি। একসময় হয়তো এই দেশে তাকে বড় করা আমার জন্য কঠিন হবে। তাই খুব দ্রুত আমি অন্য কোন দেশে চলে যাবো বলেও ঠিক করে রেখেছি।
-কিন্তু আপনি কেন আপনার অপরাধ পুলিশের কাছে স্বীকার করছেন না? আফটার অল পরিচ্ছন্ন জীবনের যে ইচ্ছা আপনি ব‌্যক্ত করেছেন তার সাথে তো এটা কন্ট্রাডিকটরি?
ঈশিতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বাচ্চাটির দিকে তাকায়। আমিও ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাচ্চাটির দিকে তাকালাম। মায়ের ওম নিতে নিতে সে নি‌শ্চি‌ন্ত মনে আঙুল চুষছে। মা বাদে পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই।
-কঠিন প্রশ্ন। এই একটা বিষয় নিয়ে এখনও আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। জানিনা কোনদিন আমার এ যুদ্ধ শেষ হবে। হয়তো সে‌দিন আমি এ কাজটা করতেও পারি। তবে আপাতত আমার একমাত্র সন্তানকে বড় করাটাই মূল দায়িত্ব বলে মনে করছি।
ঈ‌শিতা কথাগু‌লো বলা শেষ করতেই ক‌লিং বেলের শব্দ হয়। দুজন নার্স ভিতরে ঢুকে। ঈশিতাকে ওষুধ খাওয়াবে, ড্রেসিং করবে। নার্সরা আমাকে বাইরে যেতে বললো।
আমি বাইরে গেলাম। মাথাটা আমার ঘুরছে। আমার আবারও সিগারেটের পিপাসা পেয়েছে। আমি সোজা নীচে নেমে গেলাম। সিগারেট ধরিয়ে আস্তে আস্তে আস্তে বাসার দিকে হাঁটা ধরলাম।
 
ঈশিতার জীবন ও স্কয়ার হাসপাতালের ঘটনা চিরতরে মাথা থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কোন কিছুতে ব‌্যস্ত হওয়া দরকার। মিঃ রোবট সি‌রিজের অনেকগুলো পর্ব এখনও দেখা বাকী। আগামী দুদিন ওটার ভিতর ডুবে থাকবো।
 

সমাপ্ত।

(গল্পের সকল চ‌রিত্র ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্প‌নিক)

বোকা চায় বোকাদের গল্প প্রকাশ করতে। পৃথিবীর সকল বোকাপ্রাণ বোকার স্বর্গে তার বোকা বোকা গল্প তুলে ধরুক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top