“বিস্তীর্ণ চরাচরে কেউ নেই! কিছু নেই! তবুও একাকী তপন কিরণ বিলিয়ে চলে শূণ্য প্রতিদানে…” মানুষ কি এক জীবন দুঃখকে সাথে করে নেয়, খুব আপন করে? কিংবা দুঃখ কি খুব আপন হয়ে যায় কারো কারো জীবনে? কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদেরকে খুব পৌরাণিক মনে হয়! মনে হয় পৃথিবীর সব প্রাচীন করোটির না বলা কথাগুলো নিজের করে সাজিয়ে রেখেছে শেল্ফে! এই মানুষগুলোকে আঘাত করা খুব কঠিন! আঘাত করতে গেলে নিজেকেই দুমড়ে মুচড়ে যেতে হয়! আসলে এদের ব্যক্তিত্ব আর বলিষ্ঠ চরিত্রের কাছে হেরে যেতে হয়। অথচ এই মানুষগুলো ভিতরে ভিতরে কতোটা দুমড়ানো মুচড়ানো তা না মিশলে বলা কঠিন। মনজুরুল হক’কে আমি এভাবেই পেয়েছি, দুমড়ানো মুচড়ানো! মানুষটার সাথে কথা বলতে গেলেই আমি খেই হারিয়ে ফেলি! আমার কান্না চলে আসে- কোনো কারণ ছাড়াই! শব্দগুলো অনেকটা অনুকম্পার মতো শোনালেও আমি আমার মধ্যে কোনো বাড়াবাড়ি ভণিতা করিনি! আমার ভিতের বাইরে যা আছে সেইটাই কয়ে দিলাম। তাহলে, এমন ভূমিকা কেন লিখলাম, দ্যা ম্যান উইদাউট মেকাপ মনজুরুল হকের জন্য?
যথেষ্ট যুক্তি আমার আছে! যুক্তি দিয়ে খণ্ডণ করবার ইচ্ছা করছে না। বরং বোকা তার ক্যারেক্টারেই থাকুক। বোকা কোনো যুক্তি পোছে না! কোনো বিজ্ঞান পোছে না! পোছার জন্য বোকার একটা জিনিসই আছে, আর সেটা হলো জীবন!
বোকা জানে পৃথিবীতে বোকার সংখ্যাই বেশি!
বোকা জানে পৃথিবীতে বোকার সংখ্যাই বেশি! ক’জনই বা আর দালাল হতে পারে? ক’জনাই বা পারে চতুর হতে? স্বভাব চতুর জিনগত হলেও হতে পারে! এর নমুনা হাজারটা দেয়া যেতেই পারে। তার জন্য আপনাকে হাতড়ে বেড়াতে হবে। তবে হ্যাঁ, এইসব দালাল চতুরদের জন্য আছে আয়োজন। তাই একবার হাতড়ালেই দেখবেন গুষ্ঠিসুদ্ধ পেয়ে যাবেন। কিন্তু বোকা অহরহ। বোকা, প্রাণের এক আদিম বৈশিষ্ট্য! যতোদিন ব্রহ্মাণ্ডে প্রাণ আছে ততোদিন বোকার বোকামি থাকবেই! বোকা থাকবেই! অথচ এই বোকাদের খুঁজতে গিয়ে আপনার নাভিশ্বাস উঠে যাবে।
মনজুরুল হক-এর লেখা বোকার প্রিয় চারটি বই। বোকা সমাজ এই বইগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। লাইব্রেরি থেকে চুরিও করতে পারেন। হাতে চলে আসলে পড়ে ফেলুন। বিদগ্ধ বোকা হয়ে উঠুন!
আমি এমন একজন মানুষকে
নিয়ে বোকা সমাজের সামনে হাজির হয়েছি- যাকে চতুর সমাজ আড়ালে রাখতে পারলেই বাঁচে! মনজুরুল হক, নামটা হয়তো আপনারা অনেকেই শুনেছেন! আবার অনেকে হয়তো অন্যের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন! যারা আঁচ করতে পেরেছেন, তারা ঠিকই ধরেছেন, আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস, পেটকাটি চাঁদিয়াল, কাঁটাতারের এপার ওপার, অসমাপ্ত বিপ্লব অমর বিপ্লবী কমরেড চারু মজুমদার বইগুলোর লেখক আমার আজকের উনিশকুড়ির বোকাতিথি মনজুরুল হক।
তো এই মানুষটাকে কেন আমি ‘দ্যা ম্যান উইদাউট মেকাপ’ বললাম? যে মানুষটা কোনো ভণিতা করে না, বিভাজন করে না মানুষে, কঠিনেরে সহজে গ্রহণ করে, জড় অসাড় কুসংস্কারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়, বুকের ভিতর এক আকাশ কষ্ট চাপা রেখেও মানুষের জন্য দাঁড়াতে জানে সেই মানুষটাকে তো আমি মেকাপ দিয়ে সাজাইতে পারি না, তাই না?
মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী মনজুরুল হক। আরো নানান পরিচয়ে তাকে পরিচিত করা যায়। কিন্তু মানুষটি কি এতো পরিচয়ে কখনো পরিচিত হতে চেয়েছেন? না, চাননি। কোনো তকমার ধার ধারেননি। যা মানুষের, যা মঙ্গলের, যা প্রাণের, যা পৃথিবীর তাই আকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছেন। উন্মুক্ত করবার নিত্য চেষ্টা করে চলেছেন।
কোনো ধরনের ভাবাবেগ ছাড়াই কাটখোট্টা স্টাইলে মনজুরুল হককে ১৯টি প্রশ্ন করা হয়েছে। মনজুরুল হক নিজেও কাটখোট্টা স্টাইলেই উত্তর দিয়েছেন। কোনো ধরনের কর্তন ছাড়াই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো।
*** হাংরি আন্দোলন নিয়ে বোকার বিশেষ আয়োজনটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন। ***
দ্যা ম্যান উইদাউট মেকাপ, মনজুরুল হক-এর জন্য প্রশ্ন
প্রশ্ন-১: আপনার বেড়ে উঠা নিয়ে বলুন?
উঃ আমার বেড়ে ওঠা অনেকটা ছাগলে খাওয়া চারাগাছের মত। বারে বারে ডালপালা মেলতে চেয়েছি, আবারও ভেঙ্গে পড়েছি। অভাব-অনটন, খুব কম বয়সেই মারাত্মক সব তিক্ত অভিজ্ঞতায় অভ্যস্ত হতে হতে বেড়ে উঠেছি।
প্রশ্ন-২: কেমন জীবনের পথে হেঁটে যেতে চেয়েছেন?
উঃ গ্রেট থিংকিং-সিম্পল লিভিং। এভাবেই জীবন গড়তে চেয়েছি। নিপীড়িত শ্রেণির মুক্তির আকাঙ্খা বুকে নিয়ে জীবনের পথে হেঁটে যেতে চেয়েছি।
প্রশ্ন-৩: কী ধরনের কর্মজীবনকে উপভোগ্য বলে মনে করেন?
উঃ যতটুকু বিদ্যাবুদ্ধি এবং শ্রম, ততটুকু মজুরি। সেই মজুরিটা হতে হবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। সেই সঙ্গে সুকুমার বৃত্তি বিকাশের সুযোগও থাকতে হবে।
প্রশ্ন-৪: সব থেকে মধুর স্মৃতির কথা বলুন?
উঃ আমার জীবনে তেমন কোনো মধুর স্মৃতি নেই। যদি ধরতেই হয় তাহলে আমার দুটি মেয়ের জন্ম এবং তাদের বেড়ে ওঠার স্মৃতিগুলো মধুর।
প্রশ্ন-৫: সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?
উঃ সর্বক্ষণ ভাবছি। আমি দায়বদ্ধ, কিন্তু দায় মেটানোর উদ্যোগ নিতে পারছি না। এটা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে।
প্রশ্ন-৭: আপনি সফলতার পেছনে নাকি সার্থকতার পেছনে ছুটেছেন?
উঃ অভাব-অনটনের দিনগুলোতে সফলতার পেছনে, এবং এখন সার্থকতার পেছনে ছুটছি।
প্রশ্ন-৮: জীবনের মানে কী?
উঃ প্রকৃতির সঙ্গে আপোষ করে চমৎকারভাবে নির্ধারিত সময়গুলো কাটিয়ে দেওয়া আর সমষ্টির জন্য কিছু না কিছু করে যাওয়া।
*** রেহানা মরিয়ম নূর আসলে কী বলবার চেষ্টা করলো, জানতে ক্লিক করুন এখানে। ****
প্রশ্ন-৯: সাধরণের জীবন থেকে আপনি কতোটা আলাদা? কিংবা আপনি নিজেকে কেমন ভাবতে পছন্দ করেন?
উঃ শ্রেণিগতভাবে অবশ্যই আলাদা। তবে আমি এভাবে নিজেকে ভাবতে চাই না। চাই সাধারণে মিশে যেতে।
প্রশ্ন-১০: আপনি কোনো লক্ষ্যের পেছনে ছুটেছেন?
উঃ মানুষের জন্য কিছু একটা করে যেতে না পারলেও নূন্যতম কাজটা শুরু করে যাওয়া, যেন অন্য কেউ শেষ করতে পারে।
প্রশ্ন-১১: মানব সমাজের কোন বিষয়টা আপনার একেবারেই ভালোলাগে না?
উঃ নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা ঘোষণা দিয়ে অন্য প্রাণিকুলের অধিকার অস্বীকার করা, তাদের উপর অত্যাচার করা।
প্রশ্ন-১২: আপনার চারিপাশ নিয়ে কী বলতে চান?
উঃ একটা অস্থির আশাহীন সময় অতিবাহিত হচ্ছে। এটা বদলানো জরুরি। মানুষ আশাবাদী না হলে সে কোখনও সৃজনশীল হতে পারবে না।
প্রশ্ন-১৩: আবার শৈশবে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ঘটলে কীভাবে নিজেকে তৈরি করতেন?
উঃ অনেক বেশি সময় ধরে শৈশবে থেকে যেতে চাইতাম।
প্রশ্ন-১৪: দ্যা ম্যান উইদাউট মেকাপ প্রিয় মনজুরুল হক কেমন পৃথিবীর স্বপ্ন লালন করেন, সে বিষয়টিও জানতে চেয়েছি। উত্তরে জানিয়েছেন,
উঃ শ্রেণি শোষণহীন সাম্যের পৃথিবীর স্বপ্ন লালন করি।
প্রশ্ন-১৫: কেমন তারুণ্য দেখতে চান?
উঃ একরোখা, পরিবর্তনকামী, সাহসী এবং সমষ্টির কথা ভাবা তারুণ্য।
প্রশ্ন-১৬: বাংলাদেশে রাষ্ট্র সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
উঃ বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে ‘রাষ্ট্র’ হয়ে ওঠেনি। এটা নিপীড়িত শ্রেণির রাষ্ট্র হয়নি, সকল শ্রেণির রাষ্ট্রও হয়নি। হয়েছে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী মতলববাজদের রাষ্ট্র।
প্রশ্ন-১৭: বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসলে কারা (অর্থনৈতিক সঙ্গতি বিবেচ্য)?
উঃ অর্থনৈতিকভাবে শাসকের তল্পিবাহক প্রিভিলেজড ক্লাস এবং এর শাখা-প্রশাখা। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর সামগ্রিকভাবে অবশ্যই নিপীড়িত শেণিই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
প্রশ্ন-১৮: আপনার কাজ আপনি নিজে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
উঃ যথাযথ করতে পারিনি। অনেক ভুল আছে। অনেক অর্থহীন সময় পার করে ফেলেছি। তবে যেটুকু করেছি তা সৎভাবেই করেছি। সেখানে কোনো ফাঁকি নেই।
প্রশ্ন-১৯: দ্যা ম্যান উইদাউট মেকাপ মনজুরুল হকের কাছে সর্বশেষে জানতে চাই, এই সমাজের কোন বিষয়টা ভয়ঙ্কর মনে হয় এবং কেন?
উঃ ক্ষমতাহীনদের প্রতি ক্ষমতাবানদের আচরণ, কার্যকলাপ এবং রাষ্ট্রের সকল টুলস ব্যবহার করে ক্ষমতাহীনদের শোষণ করে যাওয়া।
পুনঃশ্চ: মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সাংবাদিক এবং অধিকারকর্মী মনজুরুল হককে জানবার জন্য এই সাক্ষাৎকারটি যথেষ্ট নয়। তাই এইটাকে আমি একটা ঝলক বলতে পারি কেবল। পাঠকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, তার বইগুলো পড়ুন। ব্যক্তি মনজুরুল হককে জানবার জন্য তার চিন্তাকে জানতে হবে। তার সম সাময়িক আর্টিকেলগুলো পড়ুন। মনজুরুল হক একটি ব্লগ সাইট মেনটেন করেন। আপনাদের জানার আগ্রহকে বিবেচনা করে এখানে লিংকটি যুক্ত করে দিলাম। মনজুরুল হক-এর ওয়ার্ডপ্রেস সাইটটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
বোকার হয়ে এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- মেহেদী হাসান স্বাধীন।
Pingback: প্রেম রচয়িতা
Pingback: সমরেশ নকশালবাড়ি রাজনীতি