মিয়াভাই-কে দেখতে গিয়ে প্রদর্শিত হয়ে এলাম

শেষবার মিয়াভাই আর আমার দেখা কবে হয়েছিল মনে নেই! সেই দুখ্ আজো পুষে রেখেছি! আর নাগরিক জীবনের দৌড়ঝাঁপে কবে যে ভুলে গেছি সেই দুখ্, আর মনে করতে পারিনা। এখন কেমন আছে, কোথায় আছে আমার মিয়াভাই?

তো, নানাবিধ কথাবার্তা ঝগড়াঝাটি শেষে বউ আর দুই ছেলেকে সাথে করে রওনা দিলাম মিরপুর। সাথে এক আত্মীয় পরিবার আর তাদের দুই ছেলেশিশু। চার বাদরের সাথে আমরা আরো চার বিচক্ষণ বাদর।

মিয়াভাই
মিয়াভাই

ইদের ছুটি চলছে। আমার যে খুব একটা ইচ্ছে ছিল তাও না। আবার জীবনে প্রথমবারের মতো যাচ্ছি। আমার দুই ছেলেও প্রথমবারের মতো যাচ্ছে। কেবল আমার বউটি এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ। তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অনেক কথা!

অনেক চড়াই উৎরাই শেষে পৌঁছালাম বিশাল এক গেটে। ওই গেটের ভিতরেই খাঁচার সারি। খাঁচা ভর্তি করা শত শত প্রাণ। বাঘ, সিংহ, গন্ডার, বনমহিষ, ঘোড়া, হরিণ, অজগর এই-সেই আরো কতো প্রাণ! আমার বিস্ময় আমার শিশুদেরও বিস্ময়। বিস্ময় আসলে সবার মনেই।

বিস্ময়ে অচেতন সবাই এটা-সেটা ছুঁড়ে মারছে। যেন বন্দীপ্রাণের সাথে একটা সংযোগ ঘটাবার চেষ্টা। ময়ূর পেখম মেলে নাচ্ছে- তো হাতিটা শুঁড় তুলে হাঁকছে। হরিণটা অপলক তাকিয়ে দেখছে। কুমিরটা অগভীর জলে ডুব মারছে। আর সজারু লুকাবার জায়গা খুঁজচ্ছে। প্রতিটা খাঁচার পাশেই আবার তাদের নামঠিকানা দেয়া আছে। আত্মীয়-স্বজনদের কথাও লেখা আছে। অনেকের আবার খুব দুরাবস্থা। প্রায় বিলুপ্ত। খুব দুঃখ নিয়ে তাদের এই বিষয়টাও উল্লেখ আছে।

সব দেখে মানুষেরা কেউ কেউ হায় হায় করছে। কেউ কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। কেউ লম্বা গলার জিরাফটার কানমলে দিতে চাইছে। কেউ জেব্রাক্রসিংটা কী করে জীবন্ত হয়ে উঠলো সেটা খুঁটে খুঁটে দেখছে। ক্যামেরার শাটারের শব্দে একটা কোলাহল। আবার অজস্র দর্শনার্থীর একটা বিকট কোলাহল। কোলাহলেও উৎসব হয়। মানুষ হাসে। মানুষ হাসে আর দেখে। লেজ ধরে টান দিবে, কান ধরে টান দিবে আবার চিমটি কেটে দু’ কদম পিছিয়ে খাঁচার পাশ থেকে দূরে সরে যাবে।

আমরা ওদের দেখছি- ওরা আমাদের দেখছে। সবাই খুশি তাই আমিও খুশি। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ভাবছি আর কি দেখবার বাকি আছে। যে যার মতো সন্ধান করছে। আমার মনে পড়লো বানর বাবাজির কথা। বানর নিয়ে একটা দুঃসহ স্মৃতি আছে আমার। তাই অনেককাল পরে হলেও তার সাথে দেখা করতে চাই। জিজ্ঞাস করতে চাই- আরে মিয়া ভাই এতোদিন তুমি কোথায় ছিলা? এইভাবে আমার গাঁওগঞ্জ থেকে হারায়ে গেলা! এর কী কোনো মানে হয়?

না কথাটা হয়তো ওভাবে আমার জিজ্ঞাস করা হবে না- তাও ওদের খাঁচাটার সামনে গিয়ে ওদের এক পলক দেখাতো পাওয়া যাবে। যদিও ওর হারিয়ে যাওয়ার পেছনে ওর কোনো দায় নেই। মানুষই তাড়িয়ে দিয়েছে। সবশেষ প্রাণটা হাতে নিয়ে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েও ক্ষমা পায়নি মানুষের কাছে। সবার সাথে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম মিয়াভাইয়ের খাঁচার সামনে। ওকে দেখার জন্য খুব কাছে গেলাম। যতোটা সাধারণের যাওয়া উচিত।

ওমা! একি! বানর দেখতে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম। উল্টো ও আমাকে দেখা শুরু করলো! আমি তো এদিক ওদিক তাকাই। আমার আশেপাশের সবাই আবার ওর মতো আমাকে দেখা শুরু করলো কি না। একটু ধাতস্থ হয়ে মিয়াভাইকে জিগাইলাম- কি মিয়া ভাই আমি তোমাকে দেখার জন্য আইছি- উল্টা তুমি আমারে দেখা শুরু করছো!

আমি প্রথমবার চিড়িয়াখানা গেলাম। কখনোই আমি এই “চিড়িয়াখানা”র পক্ষপাতি না। আমি ওইদিন পর্যন্ত জানতাম এবং ভাবতে চাইতাম- বিলুপ্তপ্রায় কিংবা নানাভাবে আক্রান্ত প্রাণীদের সংরক্ষণ রক্ষণাবেক্ষণ এবং মানুষ এবং অপরাপর প্রাণীর মেলবন্ধন ঘটাবার জন্যই গড়া হয় ZOO নামক অভয়ারণ্য কিংবা “প্রাণযোগ কেন্দ্র”। কিন্তু ঢাকায় সত্যিকারার্থেই চিড়িয়াখানা রয়েছে। যেখানে মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর সব প্রাণ হইলো চিড়িয়া। তুমি তাকে মারো কাট যা খুশি তা করো- কোন প্রাণ তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে না। কারণ তুমি মানুষ আর ও চিড়িয়া।আর তাই আমার দিকে নিবিষ্ট ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকা বানরটা দেখে বেশ থতমতই খেলাম। কারণ তার দুটি পা-ই ভাঙা। সে কোনোমতে টেনে টেন এধার থেকে ও ধারে যাচ্ছে। ওর চোখে মৃত্যুছায়া, যন্ত্রণা। একরাশ দুঃসহ হাতাশা। আর আছে তীব্রঘৃণা। এই চিড়িয়াখানার মানে কি? আমি জানি না। যেখানে নীরবতার বদলে মানুষের হট্টগোলে ভয়ানক ভয়ে রাজ-সিংহটাও।

মিয়াভাই
সংরক্ষণের নামে শিকল-শিক-খাঁচা আর লাঠিপেটার মানে এখন চিড়িয়াখান। যেখানে বিমর্ষ আটকা আমার মিয়াভাই!

এই চিড়িয়াখানার মানে কি? আমি জানি না। যেখানে সংরক্ষণের বদলে থাকছে শিকল-শিক-খাঁচা আর লাঠিপেটা! মানুষ যে সভ্যতার উপর ভর করেই চূড়ান্ত শিরে আরোহণ করুক না কেন- মনে রাখা দরকার যে পৃথিবী একটা জটিল আবার খুব সরল শৃঙ্খলে এখনো সজীব। এই শৃঙ্খলে মানুষ তার কুট মস্তিষ্ককে যতোটা খাটাবার চেষ্টা করবে প্রকৃতি ঠিক ততোটাই মানুষের বিপরীতে দাঁড়াবে। প্রকৃতি তোমার আজগুবি শাসনে চলছে না। চলছে তার নির্দিষ্ট সহজাত সারল্যে। মনে আছে তো নিশ্চয়- একবার পৃথিবীর বৃহৎ একটা দেশের মানুষ চড়ুইপাখি হত্যার উৎসবে মেতে কী ভয়ানক দিনটাকেই না ডেকে এনেছিল। যার কিছুকাল পরেই তারা ভয়ানক দুর্ভিক্ষে কোটি প্রাণ হারায়। অথচ যখন তারা জানলো ওই চড়ুই পাখিটাই এযাবত তাদের ফসলের সুরক্ষা দিয়েছিল! তখন ওই মানুষেরা হায় হায় করে উঠলো।শেষেটায়- ঘৃণা জানাই চিড়িয়াখানা নাম দিয়ে গড়ে তোলা এসব বন্দীশালার হর্তাকর্তাদের। আর মিয়াভাইকে দেখতে গিয়ে যারা বুঝলেন না আপনারা নিজেরাই প্রদর্শিত হয়ে চলেছেন- তাদের জন্য অনুকম্পা যেন একটু হলেও থাকে- ওই বানরের চোখে। ওই প্রাণেদের চোখে। নচেৎ এই পৃথিবী প্রাণের কোলাহলে সজীব থাকবে কি করে?

লেখক: মেহেদী হাসান স্বাধী

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top