ফয়সল নোই-এর কবিতারা
Reading Time: 11 minutesপরিচয় করিয়ে দেয়াটা ধৃষ্টতার মতোই মনে হতে পারে। কিন্তু বোকা তো আর অতো সব বিবেচনায় নিয়ে রা-টা করে না। বোকা তার ভালো লাগা না লাগার কথাই বারবার বলতে চায়। তো বোকার বাঁকে কবি ফয়সল নোই-এর কয়েকটি কবিতাই আজ আলোচনার বিষয়।
কবি ফয়সল নোই-এর কাব্যিক অভিব্যক্তি আর ব্যক্তিক অভিব্যক্তি যেন একে অপরের পরিপূরক। বোকার দৃষ্টিতে ফয়সল নোই আপাদমস্তক কবি। তার কবিতায় শব্দের প্রয়োগ এলোমেলো কিন্তু কী দারুণ দ্যোতনার খেলা। আবুল হাসানের প্রেমিকার প্রতি, দুপুর বেলায়, সন্ধ্যা, বীজ ধান, বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা ত্রিশ, সুঘ্রাণ কিংবা দুঃখ নদীর ওপার কবিতাগুলো পড়ে দেখুন। শব্দগুলো কতোটা আপন হয়ে উঠে।
ফয়সল নোই-এর সাথে মেহেদী হাসান স্বাধীনের আলাপ-আলোচনায় উঠে এসেছে কবিতার কথা। বোকা জানতে চেয়েছে-
মেহেদী হাসান স্বাধীন: শব্দগুলো আপন হয়ে উঠে কী করে? আপনার কবিতায় আমরা দেখি সরল সব শব্দের গাঁথুনি-
ফয়সল নোই: অনুভুতি শব্দের কাছে নিয়ে যায়। যেহেতু জটিল সময় ও অনুভুতিতে বাস করি, বিষয়গুলো জটিল হতে থাকে। ‘সরল শব্দের গাঁথুনি’ ভালো বলেছেন। তবে, তৎসম শব্দের বিভ্রান্তির জন্য পাঠক আমার থেকে দূরে থাকেন বলে মনে হয়।
আবুল হাসানের প্রেমিকার প্রতি
বাঁকা রেখা – পাশের গলিপথ, যে মাঠে বিকালের একটু আগে থেকে বসে আছো — পেছনের গাছ,
হলুদ পাজামা-ওড়না-জামা, দায়িত্ত্বহীন বখাটে মেঘ, বৈশাখ মাস , আহ্লাদি বাতাস, পশ্চিম দিক,
কোলে গুটানো হাত, নির্মলেন্দুর কবিতা, বৃষ্টি — তোমার পক্ষে আছে
সম্ভাব্য তোমার সকল ঢেউয়ে আছড়ে পড়া যে কোন প্রেমিক যেকোন নামে তোমাকে ডাকুক
— আমি তার স্বাক্ষ্য আছি
তারা উপায়হীন দেখবে, এক অবাধ্য কিশোর কারো কথা শোনে না
তোমার ডান সিঁথির চুল, বুক ঢেকে কালো কাতালের বিলে সারা বেলার ঝড় বাদল
দুঃখ হারানো বুনো হাঁস আনমনে ঘুরে বেড়ায়
একটা প্রজাপতি উড়ে যায় তরুন পাখা, একটা কালো পাখি উড়ে যায় তরুন পাখা
তোমার দু’ঠোঁটের বিদেশি ভাষা যত প্রেমিকের বিরুদ্ধে হাসে — পিঠে ছড়ে পড়া বাঁ সিঁথির চুল
যত প্রেমিকের বিরুদ্ধে হাসে — আমি তার পক্ষে আছি
দেশে দেশে যুগে যুগে কবি তার নিজের শব্দ সাজিয়েছে, ভাষাভঙ্গি তৈরি করেছে। কবিতায় বোকাসমাজ এই ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব দেয়। এ ব্যাপারে ফয়সলো নোই-কে বাহবা দিতেই হয়। ফয়সল নোই লিখছেন, দুপুর বেলায় দুপুরের কাব্য, সন্ধ্যা’র সময়টায় কী নিদারুণ একাকিত্বকে ভর করেছেন নিজের কবিতায়। এই একাকিত্ব কি কেবল কবির একার নাকি বোকাসমাজেরও?
দুপুর বেলায় জারুল ফুলে জারুল ফুলে দৃষ্টি তখন আটকে ছিল এমন তরো জীবন যাপন রুদ্র তরী রুক্ষ খেলায় খোল ফেঁসেছে দুপুর বেলায় ফিরতি পথে ঢেউ ছিল না তবু কেমন অচিন লাগে আঁচল জুড়ে গুল্ম কাটা মেঘ হয়েছে কোমল দেহ ক্ষীণ রেখা চোখের নেশায় তেমনি হাসে জীবন যাপন সংগোপনে প্রতিশ্রুতি দুপুর বেলায় দুপুর বেলায় | সন্ধ্যা জমিয়ে রেখেছি পরে দেখবো বলে , পরে দেখা হবে। আজ এই বিকেলের সোনালী মেঘের রঙ তোমার কাছে পৌঁছে চলে যাবো। মনে হয় মৃত্যুও কাম্য কিছু নয়, প্রাণের উত্তাপ ছেড়ে চলে যাবে কেউ । আশাহীন অভিমানে এমন কি হেমন্তের শিশিরও কিছু বলবে না ডেকে। দীর্ঘশ্বাস মথিত এই উদ্যানে বিকেলে কে হেঁটে যায় ঔষধি পদক্ষেপে বিষণ্ন প্রবীণ গাছের হেলে পড়া ছায়ায় ! ঘ্রাণে ঘ্রাণে পুষ্প হাসে । রূপের পাশে দুঃখি চন্দ্র । আলগোছে মনের শুকনো নালায় নালায় শীষ কেটে উড়ে উড়ে যায়। সেও কি তোমাকে চেনে ! সে কি জানাবে কিছু তবু অজানা সংযোজনে ? সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বিপণ্ন আলো হবে আরো একাকিত্ব বিধুর নিঃশ্বাসের সমান ! |
যতোটা পারা যাচ্ছে কবিতাকে ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছা জাগছে। যদি কবিতা কোনো ফুল হতো, কিংবা কোনো রক্ত মাংসের মানুষ? কবিতা তার থেকে কম কিসে! অঙ্কুর থেকে দুটি কুড়ি আর নতুন পাতাদের সমারোহ। কবিতা যেন রূপ-মাধুরীর অবগাহন। শিরোনামেই সে স্বাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে! কবিতা ছোঁওয়ার জন্য ভাবের হাতকে বাড়াতে হয়। কবিতা ধরবার জন্য অন্তরাত্মার গহীন দরজাটাকে খোলা রাখতে হয়।
বীজ ধান অশ্রুধারা যেন; ক্ষীণ নদীর দুইধারে বসতির কোলাহল। ঝকঝকে দুপুরেও সেখানে পাখির চিৎকার মানুষের কথা ছেয়ে যায়। তেমনি একগ্রামে এক পুরাণ মানুষ ধানি ক্ষেতের দিকে চেয়ে আছে । — সর্বস্ব যার মূলমনের কিয়দংশ অভিমানে তাকে হারাবে কোন দ্যুতি ? — যেন এই কথা জেনে আমি তাকে ভুলে থাকি যেন আরো কোন এক অন্ধপুত্র ! |
মেহেদী হাসান স্বাধীন: কবিতার শিরোনাম নির্বাচনে আপনার বিশেষ ধরণ আছে। সাধারণত একটা ঘটনার প্রকাশ হয়ে যায় আপনার কবিতার শিরোনামে। এই যেমন- বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা ত্রিশ। শিরোনাম পড়বার পর পাঠক নিজের সময়টাও যেন যাচাই করে নিতে পারছেন। কবিতার শিরোনাম নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
ফয়সল নোই: কবিতার শিরোনাম করায় কবি দাউদ হায়দারের প্রভাব আছে আমার মধ্যে। এই ধরন ওনার ভেতর বেশি আছে।
ফয়সল নোই: কবিতার শিরোনাম করায় কবি দাউদ হায়দারের প্রভাব আছে আমার মধ্যে। এই ধরন ওনার ভেতর বেশি আছে। বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা ত্রিশ আয়, এইপাশে উঠে আয়। রেল লাইনের পুবের গলিতে আমি গাঁধার পিঠে বসে আছি; অল্প কাদায় ইট বিছানো অন্যমনস্ক তিরতির বাতাস নিচে সূর্যের প্রতিফলন ধোঁয়া উড়ছে বস্তি ঘরটার পেছনে রান্নাঘর হাত ধরে সামলে উঠে আয়। সকালে লাফিয়ে সিড়ি ভাঙ্গার সময় তিন তলায় বাঁ দিকের ফ্ল্যাটে লুকানো একটা গান গলায় ঝুলে গেল অকস্মাৎ। দূর ও অতীত থেকে ভেসে আসা বাদ্যের সঙ্গে- মিলিয়ে গান গাইছি সারাদিন,এই বিকেল অব্দি ভবঘুরে তোমার প্রেমিক, সামনে অদৃশ্য স্মৃতি রাশি চোখ মেলে চেয়ে আছে অভিজ্ঞতাহীন এক ভালোবাসার ছবি দেখার গল্প শুনেছি মনে আছে। | |
*** কবি পিয়াস মজিদের, শেষ লেখা চার কবিতা পড়তে এখানে ক্লিক করুন। ***
মেহেদী হাসান স্বাধীন: কবিতা, কবিতা হয়ে উঠে কী করে? কী করে কবি বুঝতে পারেন, তাঁর লেখাটি কবিতা হয়ে উঠছে?
ফয়সল নোই: এই বিষয়ে কখনো ভাবিনি বোধ হয়। জানিনা।
ঠিক তাই। আমরা জানিনা। কবিতা নিয়ে অতোটা ডিটারমাইন্ড হওয়ারই বা কী আছে? বোকা জানেনা। তাই কি কবিতা সুঘ্রাণ ছড়ায় অনুভূতির পরতে পরতে? ফয়সল নোই লিখেছেন কবিতা সুঘ্রাণ।
সুঘ্রাণ
পিতা তার সূত্র ধরে মাটিতে নামান
হারানো ঘুড়ি । অথবা পুত্রই এসেছে কাছে
বন্ধু যার দিয়েছে সন্ধান, অনির্দিষ্ট দূঃখে ।
মুষ্ঠিতে নতুন আঙ্গুল, ভিক্ষার চাল, কোমল রৌদ্র
পায়ে পায়ে ভীড়, স্বপ্ন থেকে দূরে
হারানো স্বপ্ন ঘুরপাক খায় —
না শোনা সংগীতে । বিস্মৃত মানুষের নাম
যেন সুঘ্রাণ , জীবন থেকে সৌভাগ্য উড়ে যায় !
বনস্পতি মন ফিরে ফিরে পায় তামাদি খামার
পুরানা সন্ধ্যায় , ক্ষেত্র দেবীর রূপে ।
*** কবি সাকিরা পারভীন সুমা‘র কবিতা পড়তে এখানে ক্লিক করুন। ***
দুঃখ নদীর ওপার | |
---|---|
১. একবার ভেবে ভুলে যাই — ক্লান্তি হয় আকাশের মেঘ আর উড়ে যায় ; নিরাসক্ত চেয়ে দেখি এই মেঘ ভেসে যায় — দুঃখ নদীর ওপার দিয়ে চিরহরিৎ লোকালয়, মরুভূমি আর সমূদ্রের দিকে সংবাদ শুনি — এমন মেঘেও বৃষ্টিপাত হয় | ২. সবুজ বনাঞ্চল বেঁচে রয়। মূল ষাষ্টাঙ্গ জড়ায় মূলে — মান্য করে বনাঞ্চল বিধাতা পৃষ্ট হয়ে বুঝি আমরা প্রেম ও বিদ্যুৎ পরিবাহী গোপন পার্কের পথ — বৃষ্টিতে জলজ ফুল, নিঃসঙ্গ-মায়াময় পাতা ঝরে পরে বেঁচে ওঠে পাতা পৃষ্ট হলে আয়ূ বৃদ্ধি হয়, জানি — আমরা আজো প্রেম-বিদ্যুত পরিবাহী |
ফয়সল নোই বোকার দেখায় যতোটা ঠিক ততোটাই! বোকা কোনো বাড়তি বিশেষণ দিয়ে কবি ফয়সল নোইকে বিশ্লেষণ করতে চায় না। প্রচার বিমুখ পরোপকারী বন্ধু বৎসল সরল আর সদাহাস্য কবি ফয়সল নোই আমাদের থাকা। তার জন্য বোকা’র তরফ থেকে বারবার নব ফাল্গুনের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা।- বোকা
2 thoughts on “ফয়সল নোই-এর কবিতারা”