চৌধুরী ফেরদৌস

চৌধুরী ফেরদৌসের শব্দদ্রুম

Spread the love
Reading Time: 6 minutes

আজিজকেন্দ্রিক আমরা যে কজন অদ্বৈত পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলাম তারা ফেরদৌসকে চিনবেন। এর বাইরে অন্যরাও নিজের মতো করে চিনেন। তবুও অদ্বৈতর নাম উল্লেখ করেছি একটি বিশেষ কারণে; সে সময় তরুণ লেখক কবিদের যে জটলা সেটি আসলে আজিজের আন্ডার গ্রাউন্ডে অদ্বৈত অফিসেই ছিল। আর কবি ফেরদৌস ছিলেন সেই তরুণদেরও তরুণ। তাই সবসময় এই জটলায় থাকতে পছন্দ করতেন কবি চৌধুরী ফেরদৌস
তার নানান প্রতিভা আমাদের মুগ্ধ করতো। কখনো সাংবাদিক, কখনা কবি, কখনো কথক কিংবা কখনো ড্যাম কেয়ার আস্ফালন! কবি ফেরদৌসের মনের বয়স কখনো বাড়েনি; বুড়ো হয়নি কখনো তার মন। এখনো কবি ফেরদৌস শরীরের আঠারোর মতোন মনের আঠারো নিয়ে বাস করেন। আর ভালোবেসে লিখেন কবিতা।
বোকা তার বো-কাপা-ঠকদের জন্য ফেরদৌসের কবিতা চেয়ে এনেছে। ফেরদৌস বোকাদের ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা কবিতায় উদার হয়ে আলো ছড়াচ্ছে।

মহল্লার রোদ

রড পেটানোর শব্দে কাঁপতাছে মাটি,
তারে এক ঝাঁক কাক
মিকচার মেশিনের গান শুনতে শুনতে চুপ;
ঝাপ বন্ধ করতাছে দোকানি,
বাজখাঁই রোদ বিছিয়ে দিয়েছে পাটি…

বিড়ালটা শুয়ে আছে কুকুরটার কাছে,
ভ্যানে বাজছে ইঁদুর মারার রেকর্ড;
টুংটাং রিকশা, ভোঁ বাইক, পাজেরো পিইপ্।
মেয়েটা ঝুলবারান্দায় নাড়তাছে কাপড়,
ছেলেটা সেই দিকে চেয়ে আছে…

ফেরদৌসের লেখালেখির শুরু গত শতকের আশির দশকে। এ পর্যন্ত পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যমাঠ পেরোলেই গোলপোস্ট (১৯৮৯), ফটোকপি চাঁদ (২০০৮), পাতাসুন্দরী (২০১০), বায়োনিক বসন্ত (২০১১), রক্তফুল (২০১৭)।

ফ্যামিলি ক্রাইসিস

সব কিছুর মধ্যে
আজকাল
তুমি ঢুকে পড়ছ,

মাথা ঠেলে…

তুমি,
তোমার মলদ্বার,
ঝুলে যাওয়া স্তন,

বমি-হাগু…

সর্দি,
দাঁত-না-মাজা দুর্গন্ধ,
শ্লেষ্মা,
নাড়ি-ভুঁড়ি, স্রাব,

চুলকানি,
উৎকট প্রস্রাব…

পুঁজ,
পাঁচড়া
ঘাম,

ফোঁড়া-ঘার
কলতানি,

রক্তচক্ষু,

বানোয়াট
মিথ্যা-পচা বুলি:

ওহ্
কী অসহ্য!
তবু,

দু-ঊরু ফাঁক করে
চুলের মুটকি ধরে

আমার
মাথাসুদ্ধ

তোমার
যোনির মধ্যে
ঢুকিয়ে দিচ্ছ:

সজোরে
নাক, মুখ, চোখ…
ঠেসে ধরছ

আর
তোমার
বিউটিশিয়ান
কেয়ার টেকার,
কুক, শেফ,
দারোয়ান,
সিকিউরিটি,
মেইড, মালি,
ড্রাইভার…

আমার
পিঠ ও পাছার
ছাল-চামড়া
তুলে ফেলছে‍
পিটিয়ে!

আমার হাত
পিঠমোড়া
বাঁধা,

আমার
পুরোটা মুখমণ্ডল

তোমার
নিঃসৃত
ফেনাবর্জে
পিচ্ছিল,
লালায়িত:

আমি আর
শ্বাস
নিতে পারছি না,

হে আমার
গৃহকর্ত্রী
প্রিয়তমা…

সংসারে তো
খুঁটিনাটি
মতের অমিল
থাকেই,

তাই বলে কি
এতটা হেনস্তা
এ হেন শাস্তি!

এ জন্যই কি

দেশ বেছে,
ভালোবেসে,
ঢাক-ঢোল
পিটিয়ে…

তোমাকে আমরা
ঘরে এনে ছিলাম?

সংসারের
সব চাবি

তোমার
হাতে
তুলে
দিয়েছিলাম!

ফেরদৌসের শব্দদ্রুম

তুমি কোথায় যাচ্ছ হাওয়ায় চড়ে

তুমি কোথায় যাচ্ছ হাওয়ায় চড়ে! হাওয়ায় ওড়া ভালো নয়:
হাওয়া থাকে মাটি থেকে অনেকটাই উপরে- আর তুমি যে
হাওয়ায় উড়ছ, সেখান থেকে জমিন কি ঠিকঠাক দেখা
যায়? বরং তোমার শ্যাম্পু-করা ফুরফুরে চুল বাতাসে উড়ছে
বেশ- বাজ পাখির চঞ্চুর মতো নাক, ছিলাটানা ধনুকের
জোড়া-ভ্রু, শাড়ির নিপট ভাঁজ- তোমার মেক-আপ করা নকল
মুখখানাই বেশি চোখে পড়ে। তুমি কোথায় যাচ্ছ, কেন যাচ্ছ-
ক্ষতবিক্ষত মাটির মানচিত্র কখনো কি হাওয়ায় চড়ে
আকাশ থেকে দেখা যায়! নিজেকে দেখাতে চাও? দেখাও। কিন্তু
সে-জন্য তো আলো-ঝলমল অর্ডারি মঞ্চই ভালো- যেমন
খুশি নাচবে, পাবে প্রত্যাশিত ক্যামেরার আলো: কে দেখল আর
কে দেখল না, তাতে কী এল-গেল? হাওয়ায় চড়ে কোথায়
যাচ্ছ তুমি! হাওয়ায় ওড়া কখনোই ভালো নয়: হাওয়া থেকে
ঝরে গেলে ধুলা-ধোঁয়া-ছাই ছাড়া, বলো, আর কি-বা পড়ে থাকে?

বাদল-রাতের কাজল-চোখের তলে

হালকা কালি ছড়িয়ে দিলাম জলে
মেঘগুলো তাই বৃষ্টি হতে বলে:
‘মনখারাপ ক্যান্? একটুখানি হাস্’-
যেই বলেছি, আষাঢ়-শ্রাবণ মাস
অঝর ধারায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে!
তোমার চুলের মতোই -মনে পড়ে-

আমার আকাশ আঁধার হয়ে আসে:
দু-হাতে তাই হাতড়ে দেখি পাশে
কেউ বসে নেই- অথই কালো জল,
ঝুপ্-ঝুপ্-ঝুপ্ জলের কোলাহল-
মাথার ভেতর, কানের আশেপাশে:
ভরিয়ে দিল ভয়াল সর্বনাশে!

বৃষ্টি-ফোঁটা সাদা খইয়ের মতো
লাফিয়ে লাফিয়ে ফুটছে কত শত-
মাঠে-ঘাটে, জলে, সবুজ ঘাসে:
মেঘ চিরে যে বিজলি ভেসে আসে,
সেই আভাতে খানিক দেখা যায়;
থেমে থেমে আকাশটা গর্জায়,

কোথাও আবার হচ্ছে বজ্রপাত-
তবুও আমি বাড়িয়ে দিলাম হাত:
আঙুলগুলো ভিজছে গরল-জলে
বাদল-রাতের কাজল-চোখের তলে-
তুমি তো নেই, তোমার সুবাস ভাসে
ঝড়-ঝাপটার উত্তুঙ্গ বাতাসে!

ফেরদৌসের শব্দদ্রুম

প্রেত-অন্ধকারে…

বৃষ্টির দুর্গন্ধ গায়। মাড়িয়ে চোতরাবন, হেঁটে যাচ্ছি- সেই
শব্দ পেয়ে দু-একটি বুনো বেজি সটকে পড়ছে দ্রুত: সেকি!
এখানে কি কোনো গোরস্থান ছিল- ক্রমে হিম হয়ে আসে রক্ত…
মরাগাছ, শুকনো কতক তার ডালপালা খুঁজতে গিয়েছি
অন্ধকারে- মহাস্থানগড়ে যত ইঁদুর আজও কেটে চলে
আদিম পুস্তিকা, সেই শব্দগুলো কুটকাট কানে আসে। আহা,
দৃশ্যগুলো যদিও চিত্রিত আজ বর্ণাঢ্য কালিতে- মূর্ত এক
মহামিথ্যা ইতিহাস: কী ছিল সুসত্য তবে- বলো তো সেখানে?
জাতি-গোত্র-ধর্ম-বল-শাসকের গুণগানে যুগে যুগে সব
সত্যি মিথ্যা হয়, মিথ্যাও হয়েছে সত্যি: রোমে, ইজিপ্টে, কলিঙ্গে…
আরো কত কত স্থানে। মানুষ ভ্রমণে যায়-
কেবলই সেলফি
তোলে, মাছ-মাংস খায়, এটা-সেটা কেনে আর বেলাবেলি ঘরে
ফেরে! কিন্তু সব সভ্যতার চামচিকারা তো বেরিয়ে আকাশে
ওড়ে- কাল-সন্ধ্যার নির্জনতার থমথমে প্রেত-অন্ধকারে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *