
আশিক রেজা’র ভাগ, ভাগাড়, ভেড়া ও ভয় সংক্রান্তি
Reading Time: 13 minutesআশিক রেজা’র মতোন ঢাকাই কবি লেখকদের বেশিরভাগ শাহবাগ, আজিজ মার্কেট, ছবির হাঁট, উদ্যান, টিএসসি কিংবা কাটবন কেন্দ্রিক আড্ডাগুলোয় সরব থাকে। একটা সময় তাদের অনেকেই কোথায় যেন হারিয়ে যায়। যারা যায় তাদের অনেকেই স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। একা হয়ে যায়! কোনো দুটানা ছাড়াই মাঝেমধ্যে একাএকা ওই আড্ডাস্থলগুলো ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু রা’টা’ না করার স্বভাবটা খুব বিচ্ছিরী। আমার ভাল্লাগেনা! আমরাও এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে এলাকাগুলো চষে বেড়িয়েছি। কবিতা নিয়ে মাতামাতি করেছি। ইচ্ছে হলেই ম্যাগ করেছি আবার ইচ্ছে হলেই সব ছুড়ে ফেলেছি। আমরা কোনো দায় নিতে চাইনি। আমরা চেয়েছি শব্দ দিয়ে মানুষের চোখ মানুষের মন জাগিয়ে দিতে। যদিও আগে আমরা নিজেরাই জেগে উঠতে চেয়েছিলাম। প্রতিবন্ধকতাগুলো দেখে আমরা অনেকেই সটকে পড়েছি। কী দরকার বাবা কুয়োর ব্যাঙকে ররে পৃথিবীকে উন্মোচন করে দেয়া! আসলে আমাদের সে সাধ্য ছিলনা। আমরা খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক! কবিরা নিজেদের মতোন করে সাজিয়ে রাখে পৃথিবী। তাই আমরা ছিলাম গণমানুষ থেকে দূরে থাকা দূরের এক সমাজ। আমরা আমাদের উন্নত ভাবতাম। কেবল মদের গেলাসটা সামনে পেলেই আমরা অকৃত্রিম হয়ে উঠতাম। মানুষের হয়ে উঠতাম।
আমাদের একটা মজার ব্যাপার ছিল- আমাদের মধ্যে বাহানা ছিলনা। মেকি অ্যাপ্রোচ ছিলোনা। আমরা আসলে যা, আমরা আসলে তাই ছিলাম। শৈশবের উঠোন গল্প বৈঠকের মতো আমাদের আড্ডায় একটা ঢঙ ছিল। আমাদের অনেকেই স্রোতা আবার অনেকেই বক্তা। আবার আমাদের অনেকেই উঠতি তারকা। আমরা তারকাদের ঘণা করতাম। এখনো করি। আমরা নিজেদের খণ্ডন করতাম আবার অন্যকে ভগ্নাংশের শেষ অবদি নিয়ে পৌছে দিতাম। কবিতার জন্য আমরা কী না করেছি, সংসারের তীব্র কটাক্ষ, সমাজের ঘৃণা, রাষ্ট্রের অপপ্রচার থেকে শুরু করে প্রেমিকার থু সবই আমরা হাসিমুখে নিয়েছি। তবুও আমরা মানুষের জন্য শব্দ বিনির্মাণ করবার চেষ্টা করেছি, আড্ডা অব্যাহত রেখেছি! কিন্তু… এখন?
এখন আমরা কুয়োয় ঢুকে গেছি। আমরা বুঝে গেছি এই রাষ্ট্রের সব বেহায়া বদমাশ ইতর। আমরা সরে গেছি আলোচনা থেকে। আমরা জেনে গেছি, আমাদের লোকেরাই লেবাস ধরেছে, মুখোশ পরেছে। তাই আমরা কুয়োয় ঢুকে গেছি।
আকাশে মাঝেমধ্যে তারাদের খসে পড়ার আলোকছটা দেখি। কতো আগে সে খসে পড়েছিল জানি না; জানতে চাইও না। কিন্তু তাদের খসে পড়া আমাদের চোখ আকাশে তুলে দেয়। আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হওয়ার পর আবার কুয়োয় ঢুকে যাই। হঠাৎ মনে হলো, আমাদের সাথে আড্ডা দেয়া একজন আশিক রেজা ছিল। বলতো কম, দারুণ শ্রোতা, কিন্তু কী যেন বলতে চেয়ে আবার চুপ হয়ে থাকতো। একাই যেন বেদনাভার বয়ে বেড়াত! কিন্তু কিসের বেদনা, জানতে চাইনি আমরা; আমাদেরও তো কম বেদনা ছিলনা! কী একটা তাড়না নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আশিক রেজা বেঁচে আছে। সংসার নিয়ে সমাজ নিয়ে দূরে যেতে যেতে ঠিক আমাদের বিপরীত পাশে পৌঁছে গেছে।
কবি আশিক রেজা আমাদের বেদনাসম বন্ধু। বেদনাকে আমরা ভালোবাসি, আশিক রেজাকেও আমরা ভালোবাসি।
আশিক রেজা তার নতুন কাব্যগ্রন্থ “ভাগ, ভাগাড়, ভেড়া ও ভয় সংক্রান্তি”র পাণ্ডুলিপি সম্পন্ন করেছে। কী দারুণ খবর!
বললাম বো-কাপা-ঠকদের “ভাগ, ভাগাড়, ভেড়া ও ভয় সংক্রান্তি”র কবিতা পড়তে দেন। আশিক রেজা সানন্দে তার প্রকাশিতব্য “ভাগ, ভাগাড়, ভেড়া ও ভয় সংক্রান্তি”র কবিতা পাঠালেন। “ভাগ, ভাগাড়, ভেড়া ও ভয় সংক্রান্তি” কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ৫টি কবিতা বো-কাপা-ঠকদের নিমিত্তে-
উপকথার পরের কথা
দু’একটা ভেড়া জবাইখানার ডাক পেলেই
গেল গেল রব ওঠে শেয়ালের
কাকেরাও বেশ সহানুভূতি সম্পন্ন
ভাগারে বাগে পেলে কাকের মাংসই খেয়ে নিচ্ছে
কেবল কোন কুকুরের ভোগে গেলেই তারস্বরে চিৎকার
শুয়োরেরা গতকাল ভুলে আর্জি জুড়েছে হত্যা মামলার
মামলা, হামলা, অনুকম্পা, হুঙ্কারেও স্থির ভেড়াদল
নিশ্চিত কুকুর, শেয়াল আর শুয়োরেরা
কাকের কা-কা’য় কে করে কান
গা-ভাসানো গড্ডল চায় মানুষের মান-
সেও সামান্য, জোর নাই, উজানের সাম্পান!
ভেড়া কোন পশু নয়, ভাগারের কাক নয় বুদ্ধিজীবী,
শুয়োর-কুকুর নয়- ভেড়া, সামনে তোমার- আদি ও আসল রাজনীতিজীবী
কাক ও কুকুর, শেয়াল ও শুয়োর, ভাগ ও ভেড়াদের গণতন্ত্র-
এমনই শাস্ত্রবৎ কথার কথা!
নরম ঘাসের কাছে মায়াময় এঁড়েদের দাঁত
ভাগারে সুশাসন কেমনতর?
কুকুরের জটলা নাকি আরও মৃত্যুর অপেক্ষা
পশুদের শৃঙ্খলা মানে তো যশ্মিন দেশে যদাচার, শান্তি রসাতল, শক্তিমানের জল
পশুদের বিচার মানে জঙ্গলের আইন আর চালাক বানরের উপকথা
‘সু’রই সুশাসন, পশুদের নয়-
তবু, নেহায়েত পশু হও ভেড়া
মুহূর্তের হায়েনা হও, মাংশাসির রক্তে মিটুক ক্ষণিক পিপাসা
তারপর-
বর্গাদার অক্কাপেলে, নতুন সূর্যের তলে, নতুন সম্ভাবনা করতে পারো আশা।
***“ফয়সল নোই-এর কবিতারা” পড়তে এখানে ক্লিক করুন***
তোমার কাছে যাবো, মা-
তুমি তো নও নদী
তোমার মতো, তোমার পথে বইবে নিরবধি
আকাশ দূরের, সে তার মতো থাক
মায়ের ছেলে, সে তার মাকে পাক
দূরের নদী, দূরের আকাশ, দূরের তারারা
তোমার ছেলে তুমি না নিলে নেবে কাহারা
তারা কারো কেউ নয় নামের পাহারা
দূরে কেন, দৌড়ে আসো, কোথায় তুমি মা?
তোমার কাছে যাবো আমি যেতে পারি না
তোমার কোলের অপেক্ষায় মা ভালো লাগে না
তোমার কাছে যাবো আমি যেতে পারি না
কোথায় তুমি, আমার কাছে চলে আসো মা
যারা আসেনা লাগলে কাছে তারা তো নয় মা
দেশ বলো আর নদী বলো মা তো আর না
আকাশ যতই বিশাল হোক আর নুনের সমুদ্দুর
তারা থাকে তাদের মতো দরকার মাফিক দূর
মায়ের কোল তো দূরের আকাশ তারার মতো না
কানলে ছেলে, ডাকলে ছেলে, চলে আসে মা
তোমার কাছে যাবো আমি যেতে পারি না
আসো তুমি আমার কাছে চলে আসো মা
তোমার কাছে যাবো, আমি যেতে পারি না
এই না পারা, তোমার অভাব ভুলতে পারি না
তোমার কাছে যাবো বলা থামাতে পারি না
তোমার কাছে যাবো বলে রইতে পারি না
শাখের করাত-উভয়ের টান বইতে পারি না
তাই গোপনে, খুব গোপনে বলতে ছাড়িনা
যেমন জানি সদাই শুধু আমার কথা ভাবো
না পারি না, তবু বলি –
তোমার কাছে যাবো গো মা
তোমার কাছে যাবো
***“কবিতায় সাকিরার বসবাস” পড়া যাবে এক ক্লিকেই***
পাঠা পাঠ: আশিক রেজা
খোদা না খাস্তা মধ্যরাতে তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে একটা যমুনাপাড়ী ছাগল। ডাইনে বায়ে গলা মেলায় আরও দুই একটা। প্রথমটার কারণ অনুমেয়। যদিও তার জেন্ডার সংবেদনশীল ডাটা নাই, সনদ নাই। তবু, বাংলায় কে কারে গোণে? হাইলোন গরম হওয়ারও সময় অসময় নাই। কুকুর ডাকলেও বুঝি। এমনকি মুয়াজ্জিনের সাথে সংগত করে যে কুকুরেরা, তাদের জন্যও ফতোয়া বিদ্যমান। আর গুলান চেচাঁয় ক্যান? এই বিষয়ে ফতোয়া কী? ফেসবুকে এমতো স্ট্যাটাস দিতেই টায়-টায় হাজির পেট কেটে আংটি রেখে দেয়া লেজওয়ালা বিশেষজ্ঞ সকল। পাতা ওল্টাবার আগেই, এমনকি প্রথম শব্দটা বানান করে পড়ে ফেলবার আগেই ফলোয়িং মন্তব্যে কান টনাটন জাকারবার্গ। সকলেই পারে পাঠা দেখাবার কাজ, তবু, যমুনার ঐপাড়ে- পাঠাদের জয়গান। হতে পারে কাঠাল পাতায় তাদের ঘেন্না ধরে গেছে। কেউ কেউ পাঠা, তবু সকলেই পাঠা হতে চায়। সুতরাং সাত সকালে, গৃহস্থের দায়িত্বপালনের আগেই, তারস্বরে জানিয়ে দেয় নিজস্ব অবস্থান, পরিচয়, উদ্দেশ্য ও অভিমুখ। পাঠাও বুঝে গেছে, বাংলায় ল্যাঙরাও হাডুডু’র প্রতিযোগী। ভব্যতার দরকার নাই। কোন বিদ্যা, হাতিয়ার, প্রশিক্ষণ অপ্রয়োজনীয়। বাঁশ ফাটালেই বাঁশি হয়।
পাঠার শিশ্ন অনাবশ্যক।
জানে পাঠা ভালো করে, পিতা শিশ্ন রক্ষক।
কিছু করা লাগবে না। কিচ্ছুটি করবে না, মেনিমুখো তক্ষক।
আবার –
খোদকারী খাশিও ফায়ে ফায়ে হয়ে যাবে পাঠাদের সর্দার।
নাতি নয়, পাতি নয়- লাইন দেবে মাতারি। লেজ নাড়াবে কুত্তার বাচ্চা।
সময়ে সময়ে শুধু ভাব নিতে হয়।
বগলে ব্যাদান দু’পেয়ে পশুরা।
বাংলার চাচা মিয়া –
তোমাতেই কি শুরু বাংলার আশুরা?
***হাংরি আন্দোলন নিয়ে পড়ুন বোকার বিশেষ লেখা- হাংরি, খোলস ভাঙার প্রচণ্ড ইচ্ছা!***
বাজান: আশিক রেজা
জানি চলেই যাবে! আমিও, ডাক আসলেই!
তারও আগে, কাবাডির ফাঁকে, পায়ের দিকে তাকিয়ে
দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া কতিপয় শ্বাস, বাবা, তোমায় একটু দেখি
একটু তো বসো! ফুস করে উড়ে গেলে জলের মতো-
কোথায় পাবো এ শীতলতা?
বাজান, বসো, পান খাও! বরং ঘুমাও
করতলে ঘেমে ওঠা সীমিত শ্বাস-
সানকিতে বেড়ে রাখা বখরার সময়
শ্বাসে গেঁথে রাখি শ্বাস- কে জানে কখন কার ডাক এসে যায়!
***বিশেষ সাক্ষাৎকার- মনজুরুল হক: দ্যা ম্যান উইথাউট মেকাপ! পড়ুন বোকায়***
কাক- কোকিলের কাল: আশিক রেজা
এখন কাকেদের দিন
এখন বায়সের দিন
তবু দিন-দুপুরে দেখিনা কাকেদের ছায়া
কানে শুনিনা কর্কশ-কা-কা
হঠাৎ কাকেরা কোন উদ্দেশ্যে উধাও-
জানলে বলে দিন!
না। বলতে হবে না- বোকা বাক্সের গল্প,
সহসা সকল সদ্য গজানো বারুদে বুদ্ধিজীবী,
চিড়িয়াখানায় পড়ে থাকা হাড় আর উধাও চিড়িয়ার খবর।
না বলে দিলেও চলে-
এমন বর্ষণের দিনে রাস্তাা ভর্তি থলথলে ময়ুরীর না নাচার কারণ।
শুধু যদি জানো-
কাক কে বলে দিও
এখন বসন্ত, কোকিলেরও কাল বটে
নগরী ভর্তি তার সার্কিট ক্যামেরা, খোঁজে শুধু গর্ভাশয়
ঘরে কাক-গিন্নী-একা!
আশিক রেজা’র প্রকাশিত অন্যদুটি কাব্যগ্রন্থ- বায়ুপরাগী নৈবেদ্য (২০১১), দোলনকাল (২০১৪)। কবির “ভাগ, ভাগাড়, ভেড়া ও ভয় সংক্রান্তি” খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে, কবির জন্য শুভ কামনা।
2 thoughts on “আশিক রেজা’র ভাগ, ভাগাড়, ভেড়া ও ভয় সংক্রান্তি”