Table of Contents
Toggleবাংলার ভূত সমাজের পরিচিতি
পেত্নী
১) পেত্নী হলো নারী। বেঁচে থাকতে যার কিছু অতৃপ্ত আশা ছিল এবং অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেছে। পেত্নী শব্দটি সংস্কৃত প্রেত্নী শব্দ থেকে এসেছে (পুরুষবাচক শব্দ প্রেত)। এসব নারীভূত সাধারণত যে কোন আকৃতি ধারণ করতে পারে, এমনকি পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। পেত্নীরা বেঁচে থাকতে কোনো অপরাধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে এবং মৃত্যুর পর অভিশিপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করে। পেত্নীরা ভীষণ বদমেজাজী আর কাউকে আক্রান্তের আগ পর্যন্ত স্পষ্টতই মানুষের আকৃতি ধারণ করে থাকে। পেত্নীদের আকৃতিতে একটিই সমস্যা রয়েছে, তা হলো তাদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো।
লোকেরা বলে, পেত্নীরা মাঝরাতে, নির্জন পথ বা গাছতলায় বসে থাকে। কেউ তাদের ডাকলে তারা খুব কোমল কণ্ঠে উত্তর দেয়, কেউ আবার বলে, ওরা শুধু হাসে, এক রকমের ঠান্ডা, গায়ে কাঁটা দেওয়া হাসি। কেউ যদি ভুল করে তাদের অনুসরণ করে, তখন তারা নিজের রূপ বদলে ভয়ংকর চেহারায় রূপ নেয়।
অনেক লোক আবার বিশ্বাস করে, পেত্নী মানুষের ঘরে প্রবেশ করতে পারে, স্বপ্নে এসে ডাকে, এমনকি প্রেমিকের রূপ ধরে বিভ্রান্ত করে।
পেত্নী কেবল গল্প নয়- এটি একটি প্রতীক। নারীর অসমাপ্ত জীবন, প্রেমহীন মৃত্যু, সমাজের দ্বারা ত্যাজ্য হওয়া নারীর অভিশপ্ত সত্ত্বা। পুরুষশাসিত সমাজে, যেখানে নারীর চাওয়া-পাওয়া প্রায়ই গুরুত্ব পায় না, সেখানে পেত্নী হয়ে ওঠে এক বিপন্ন আত্মার প্রতিবাদ।
পেত্নী চরিত্রটি ভয়ংকর, কিন্তু তার ভয় শুধু বাহ্যিক নয়— তার ভয়ের পেছনে রয়েছে দগদগে এক সামাজিক বাস্তবতা। প্রেমহীন মৃত্যু, অসমাপ্ত কামনা, অপমান, আর প্রতারণার একটি অলৌকিক পরিণতি।
পেত্নীর পা পেছনের দিকে— কারণ পেত্নী তার জীবনে কখনও সামনে এগোতে পারেনি!
শাকচুন্নি
২) শাকচুন্নি এক ধরনের পেত্নী, বাংলার লোকবিশ্বাসে যার জন্ম ঘটে- অল্প বয়সে অপঘাতে মারা যাওয়া বিবাহিত নারীর আত্মা থেকে। বিশেষ করে, যে নারী আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেছে— বিয়ের পরে, তবে মাতৃত্বের আগে— তার আত্মাই নাকি সবচেয়ে বেশি ভয়ানক শাকচুন্নিতে রূপ নেয়। প্রেম, যৌবন, আকাঙ্ক্ষা— সবকিছু অসম্পূর্ণ রেখে যাওয়া আত্মারা যখন ঘুরে বেড়ায়, তখনই তারা হয়ে ওঠে শাকচুন্নি।
শাকচুন্নির আবাস জলাভূমি, বিল বা হাওরের ধারে থাকা বড় পুরোনো গাছের ডাল। কখনো কখনো সে ধানক্ষেতের মাঝে বা নির্জন পুকুরঘাটেও চলে আসে। রাতের নিঃস্তব্ধতা, কুয়াশা, আর জলের ঢেউয়ে তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।
শাকচুন্নিকে সাধারণত সাদা শাড়ি পরা, খোলা চুলের এক সুন্দরী নারীর রূপে দেখা যায়। সে এমনভাবে তরুণ পুরুষদের আকৃষ্ট করে যেন তারা বুঝতেই পারেনা তার আসল পরিচয়। শাকচুন্নি কণ্ঠ খুব কোমল আর মোহময়তা ভরা থাকে। চোখে থাকে আকুতি, আর কথায় থাকে ফাঁদ। খুব আলাভোলা তরুণ যুবকদের সে- সোনা, “একটু মাছ ধরে দেবে আমায়? আমার বড্ড খিদে পেয়েছে! আমায় একটু মাছ দেনা তোকে খুব আদর করে দিবো!” এমন করুণ সুরে আদর মাখা গলায় ডাকতে থাকে!
শাকচুন্নি পেত্নীর এই অনুরোধে সাড়া দিলেই বিপদ। কারণ, শাকচুন্নিকে মাছ দেয়া মানেই নিজের আত্মাকে তার হাতে সঁপে দেয়া। কেউ যখন শাকচুন্নিকে মাছ এনে দেয় বা তার অনুরোধে সাড়া দেয়, তখন সে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলে— তার রক্ত শুকিয়ে যেতে থাকে, কেউ বলে তার ঘুম আর ভাঙে না। শাকচুন্নি তার বলির পাঁঠাকে নিজের জগতের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। মাঝে মাঝে সে তাকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে বা ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়।
শাকচুন্নির কাহিনী শুধুই ভয়ের নয়, বরং এটি নারী জীবনের অসমাপ্ততার প্রতীক। বাংলার গ্রামীণ সমাজে নারীর আকাঙ্ক্ষা, প্রেমের অতৃপ্তি এবং জীবনের অসম্ভব শোকগুলো এই ভয়ের মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়। শাকচুন্নি যেন সেইসব কষ্টে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া স্বপ্নের অলৌকিক প্রতিশোধ।
শাকচুন্নি এক রহস্যময় প্রতীক— সে একই সঙ্গে আকর্ষণীয়, করুণ আর ভীতিকর। তার গল্পে রয়েছে সৌন্দর্যের মোহ, মৃত্যুর ছায়া আর সমাজের চাপাব্যথা। বাংলা লোকসাহিত্যে শাকচুন্নি কেবল একটি পেত্নী নয়, সে এক অসমাপ্ত জীবনের আর্তনাদ, যা আজও ঝড়ের রাতে বাঁশবন কাঁপিয়ে বলে ওঠে— “একটু মাছ দেবে আমায়? বড্ড খিদে পেয়েছে!”
নিশি
মানসিক দুর্বলতা আর আবেগকে অস্ত্র বানায় ভয়ংকর এই নিশি
নিশিভূত বাঙালি লোকবিশ্বাসে এক রহস্যময় ও ভয়ংকর অস্তিত্ব। নিশি অন্য ভূতেদের মতো শুধু নির্জনতা বা অন্ধকারের সুযোগ নেয় না—তারা মানুষের মানসিক দুর্বলতা ও আবেগকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। নিশি গভীর রাতে শিকার বেছে নেয় এবং তার প্রিয়জনের কণ্ঠ নকল করে ডাকে। এই ডাক এতটাই সত্যি মনে হয় যে মানুষ বুঝতেই পারে না এটি এক বিভীষিকাময় ফাঁদ। গভীর ঘুমের মধ্যে সেই স্বজনস্বরের আহ্বান শুনে ঘুমন্ত ব্যক্তি মুগ্ধের মতো উঠে পড়ে, দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়—আর কখনো ফিরে আসে না।
নিশির সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো এর সম্মোহনী ক্ষমতা। নিশির ডাকে সাড়া দিলে ব্যক্তি যেন জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে, কোনো প্রতিবাদ বা সচেতন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে হাঁটতে থাকে এক অজানা গন্তব্যের দিকে, নিশির টানে। অনেকে মনে করেন, যেসব মানুষ একবার নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়, তারা আর মানুষ থাকে না— তারাও একসময় নিশিতে পরিণত হয়। এই ধারণা নিশিকে শুধু এক ভূত নয়, বরং এক ছোঁয়াচে অভিশাপে পরিণত করে, যেটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে নতুন শিকার বানিয়ে।
লোককথায় বলা হয়, নিশি কাউকে তিনবারের বেশি ডাকতে পারে না। সে কারণে বলা হয়, রাতের গভীরে কেউ যদি নাম ধরে ডাক দেয়, তাহলে এক বা দুইবারের ডাকেও সাড়া দেওয়া উচিত নয়। যদি কেউ তিনবার ডাকে, তবে ধরে নেওয়া হয় সেটা নিশি নয়, কারণ নিশির ক্ষমতা তিনবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই কুসংস্কার বহু মানুষকে সতর্ক করে চলতে সাহায্য করেছে, যদিও কেউ কেউ এটিকে নিছক গল্প বলেই উড়িয়ে দেন।
কিন্তু সবথেকে আশ্চর্য দিক হলো, কিছু তান্ত্রিক বা কালোজাদুকর এই নিশিকে নিজেদের কাজে লাগায়। তারা বিশেষ সাধনার মাধ্যমে নিশিকে বন্দি বা নিয়ন্ত্রিত করে এবং প্রতিশোধ বা শত্রু নিধনের উদ্দেশ্যে অন্য মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এর ফলে নিশি কেবল একটি অতিপ্রাকৃত ভয় নয়, বরং মানব-সৃষ্ট এক অস্ত্র হয়ে ওঠে। এ দিক থেকে নিশি যেন ভৌতিক না হয়ে এক সামাজিক আতঙ্ক, এক অন্ধকার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।
মোহিনী
প্রেমের অভিশপ্ত গ্ল্যামারাস এক আত্মা
৪) মোহিনী এক ধরনের পেত্নী, বিশেষত সেই নারীদের আত্মা যারা জীবদ্দশায় প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন বা বিয়ের আগেই হৃদয়বিদারকভাবে আত্মহত্যা করেছেন। তাদের প্রেম, আশা, আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি পূর্ণ হয়নি; আর এই অসম্পূর্ণতা থেকেই জন্ম নেয় মোহিনী রূপের এক বিপজ্জনক আত্মা।
মোহিনী সাধারণত হয় একদম গ্ল্যামারাস, অতুলনীয় সুন্দরী, যাদের সাজ-সজ্জা দৃষ্টিনন্দন। তারা ঝলমলে পোশাক পরে, ফোরোশপযুক্ত, যেন এক দৃষ্টিনন্দন স্বপ্ন। এদের সৌন্দর্যে সহজে মানুষ মোহিত হয়—বিশেষত দেখতে আকর্ষণীয় পুরুষেরা।
মোহিনী মূলত যুবকদের টার্গেট করে। তারা তাদের আকর্ষণ করে নিজের জালে ফেলে নিয়ে যায় এমন এক জায়গায় যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায়, মোহিনীর মোহে পড়ে যাওয়া কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
মোহিনী প্রতিশোধ পরায়ণ। যারা তাদের ভালোবাসাকে না মেনে চলে যায় বা তাদের সাথে প্রতারণা করেছে, মোহিনী তাদের জীবন অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়।
বাংলা লোককথায় মোহিনীকে এক ধরণের সতর্কতা হিসেবে দেখা হয়— প্রেমের ধোঁয়াশায় অতিরিক্ত আবেগ বা মোহ মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। মোহিনী হয়ে ওঠে সেই মোহের প্রতীক, যা একদিকে যেমন আকর্ষণীয়, অন্যদিকে ঘোর বিপদ।
প্রাচীন গল্পে বলা হয়, মোহিনী নদীর তীরে বসে থাকে, চাঁদের আলোয় ঝলমলে পোশাকে, যাত্রীরা তাকে দেখে মুগ্ধ হয়। কেউ তার কাছে গেলে সে তাকে তার নিজের মতো করে বেঁধে ফেলে। কেউ কেউ মনে করে, মোহিনী আসলে প্রেমের অসম্পূর্ণতা ও প্রতিশোধের এক রূপান্তরিত আত্মা।
মোহিনী কেবল ভূত নয়, বরং প্রেমের ব্যর্থতা, অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশোধের মূর্ত রূপ। তার গ্ল্যামারাস ছদ্মবেশ মানুষকে মোহিত করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নিয়ে আসে ধ্বংস ও নিঃশ্বাসহীন এক নিঃসঙ্গতা।
স্কন্ধকাটা
৫) স্কন্ধকাটা হলো বাংলার লোকবিশ্বাসের এক ভয়ংকর কিন্তু গভীর দার্শনিক ভূতচরিত্র—যারা নিজের দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারিয়ে আত্মার অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলে। তার ভয় জাগে, কারণ সে নিজেই জানে না—সে কে, কোথায় যাচ্ছে, এবং কাকে চাইছে আঘাত করতে।
যারা কোনো দুর্ঘটনায়—বিশেষ করে রেল দুর্ঘটনা, গলাকাটা হত্যা বা আত্মহত্যার ফলে—মাথাবিহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাদের আত্মা থেকেই জন্ম নেয় স্কন্ধকাটা ভূত। স্কন্ধ শব্দটি সংস্কৃত, যার অর্থ কাঁধ। অর্থাৎ, যাদের কাঁধ আছে কিন্তু মাথা নেই, তারাই স্কন্ধকাটা। অনেক অঞ্চলে এরা গলাকাটা নামেও পরিচিত।
লোকবিশ্বাসে, এসব আত্মা এত দ্রুত এবং বেদনাদায়কভাবে মৃত্যুবরণ করে যে, তারা মৃত্যুর পরও তাদের নিজের অবস্থার বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন হয় না। তারা বোঝেই না যে, তারা মৃত আর মাথাহীন!
স্কন্ধকাটার সবচেয়ে ভয়াবহ বৈশিষ্ট্য হলো—তাদের মাথা নেই। কাঁধ থেকে গলা বিচ্ছিন্ন, কোনো মুখ নেই, চোখ নেই—তবুও তারা দেখে, শোনে, ধরে, এবং আক্রান্ত করে। তারা সাধারণত রেললাইন, পুরোনো কসাইখানা, নদীর ঘাট, বা গলাকাটা খুনের স্থান ঘিরে ঘুরে বেড়ায়। রাতের আঁধারে, ঘন কুয়াশার মধ্যে এদের আবছা অবয়ব দেখা যায়— মাথাবিহীন স্কন্ধকাটা হেঁটে চলেছে নিঃশব্দে। কেউ টের পেলেই, তীব্র আক্রোশে আক্রমণ করে। স্কন্ধকাটা মানুষ দেখলেই বা মানুষের আওয়াজ পেলেই অনেক সময় আক্রমণ করে। কারণ সে মনে করে, সবাই তাকে উপহাস করছে, অথবা কেউই তাকে সাহায্য করেনি তার মৃত্যুর সময়।
তবে একটি মজার ব্যাপার হলো- মাথাহীন হওয়ায় তারা বিভ্রান্ত হয় সহজেই। দিক নির্ধারণে ভুল করে, শিকারকে ভুল পথে ধাওয়া করে, কিংবা নিজেরই ছায়ার পিছু পিছুই ছুটতে থাকে। তাই লোকেরা বিশ্বাস করে, সাহস ও কৌশলে স্কন্ধকাটার হাত থেকে বাঁচা যায়।
গ্রামাঞ্চলে অনেক মা-দাদি শিশুদের বলেন—রেললাইনের ধারে একা যাস না, স্কন্ধকাটা ধরে নিয়ে যাবে!
আবার রাতে কোনো ঝোপের আড়ালে শব্দ হলে বলা হয়— চুপ! ওটা নিশ্চয় স্কন্ধকাটা!
এই স্কন্ধকাটার কাহিনী অনেকটা সামাজিক ভয়ের প্রতিফলন— হঠাৎ মৃত্যু, সহিংসতা, এবং মানুষের একাকীত্ব। স্কন্ধকাটা এক প্রতীকময় সত্ত্বা— এটি কেবল ভয় নয়, হীনমন্যতা, অসম্পূর্ণতা, ও আত্ম-চেতনার অভাবের প্রতীক। এরা যেন বলে— আমি কে ছিলাম, তা আমি নিজেই ভুলে গেছি। তারা মানুষের মাঝে ঘোরে নিজের পরিচয় খুঁজতে, অথচ হিংস্র হয়ে ওঠে কারণ কেউ তাদের সত্ত্বাকে স্বীকার করে না।
ব্রহ্মদৈত্য
৬) ব্রহ্মদৈত্য শব্দটি এসেছে ব্রাহ্মণ ও দৈত্য— যেখানে ব্রাহ্মণ নির্দেশ করে পুণ্যবান, জ্ঞানী ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে এবং দৈত্য মানে আত্মা বা ভূত। ব্রহ্মদৈত্য হলো সেই আত্মা বা ভূত, যিনি জীবিত অবস্থায় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং যিনি পৈতাবিহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। অর্থাৎ, এই ভূত কোনো বংশপরিচয় ছাড়া পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এমন ব্রাহ্মণের আত্মা ব্রহ্মদৈত্য হয়ে উঠতে পারে।
ব্রহ্মদৈত্য সাধারণত ধূতি ও পৈতা পরিহিত অবস্থায় থাকে। ধূতি হলো সাদা রঙের পোশাক যা সাধু-সন্তদের পরিধেয়। পৈতা হলো মাথায় বাঁধা একটি ছোট চাদর বা কাপড়ের ফিতে। এদের রূপ সাধারণত পবিত্র, শান্তিপূর্ণ এবং গম্ভীর। তারা মানুষকে ভয় দেখায়, বরং তাদের উপস্থিতি শান্তি ও আশীর্বাদ বয়ে আনে।
ব্রহ্মদৈত্যরা খুবই দয়ালু এবং সহায়ক। তারা মানুষের কল্যাণে কাজ করে, বিশেষ করে যারা ধর্মমনা ও সৎ। অনেক ক্ষেত্রে তারা বাড়ির পবিত্র স্থান, দেবদারু গাছের তলে বা খোলা চত্বরে বাস করে। তাদের উপস্থিতি স্থানটিকে পবিত্র ও সুরক্ষিত করে।
বাংলা লোককাহিনীতে ব্রহ্মদৈত্যদের চরিত্র প্রশংসিত হয়েছে। তারা প্রায়ই জীবিতদের সাহায্য করে, বিপদ থেকে বাঁচায় এবং সৎ কাজের জন্য প্রেরণা যোগায়। তাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভক্তি রয়েছে।
ব্রহ্মদৈত্যরা পবিত্র আত্মা হিসেবে বিবেচিত, যারা জীবিতদের পথে ধর্ম ও ন্যায়ের শিক্ষা দেয়। তাদের উপস্থিতি একটি স্থানকে আশীর্বাদিত করে এবং শত্রুতা থেকে রক্ষা করে। ব্রহ্মদৈত্য হলো এক ধরনের পবিত্র ও দয়ালু ভূত, যারা জীবনকালে ব্রাহ্মণ ধর্ম পালন করেছে এবং মৃত্যুর পরও মানুষের সহায়ক হয়ে থাকে। তারা ভয়ঙ্কর নয় বরং আশীর্বাদস্বরূপ, বাংলার লোকজ আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের একটি সুন্দর প্রতীক এই ব্রহ্মদৈত্য ভূত।
মামদো
৭) মামদো-ভূত- সাধারণত মুসলমান পুরুষ ভূত হিসাবেই প্রচলিত! মামদো মূলত মামু বা মামা (পারিবারিক সম্মোধন) শব্দটি থেকে এসেছে। মামদো এমন এক ভূতের চেহারা ফুটিয়ে তোলে যার ধর্মীয় বা সংস্কৃতিক পোশাক / ভাষা মুসলমানদের মতো, অর্থাৎ পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা, টুপি পরা ভূত— তার চোখগুলো কোটরে বসে গেছে। বেশ লম্বা আর গম্ভীর! তাকে দেখলে গা শিউরে উঠবে!
বোকা ধারণা করে এটা মূলত বঙ্গসমাজকে ব্যালেন্স করবার জন্য ব্রহ্মভূতের প্যারালাল এই মামদো ভূতের আবির্ভাব। যদিও এর কোনো সোর্স হাতে নেই।
মামদো ভূত মৃত কোনো ধার্মিক লোক, যার মৃত্যুতে কোনো অসন্তুষ্টি, আফসোস বা পাপ ছিল, তাই তার আত্মা শান্তি পায়নি। কেউ কেউ বলে, তারা জ্বীনের মতো– কিন্তু কম শক্তিশালী। তারা মানুষের কাছে কোনো উপকারের জন্য আসে না, বরং ধর্মীয় উপদেশ বা কথায় ভয় দেখায়। মামদো ভূত ডিসিপ্লিন ভূত। মামদোরা শাস্তি দেয়, ভয় দেখায়, কিন্তু ডাইনীদের মতো পিশাচ নয়।
বোবা
৮) বোবাভূত বাংলা ভূতবিশ্বাসের সবচেয়ে পরিচিত, অভিজ্ঞতাভিত্তিক, এবং আধা-চিকিৎসাবিজ্ঞানের সীমানায় ঘোরাফেরা করা এক অসাধারণ ভূত—বলা যায় আপামর বাঙালি নিজের জীবনে অন্তত একবার এই ভূতের হাতে ধরা খেয়েছে… মানে এই ভূতকে অনুভব করেছে।
অর্থাৎ খুবই পরিচিত ভূত, এই ভূতের কাজ ঘুমের মধ্যে আছর করা। তখন মানুষ অনেক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে- নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় মনে হয় মরে যাচ্ছে! এ সময় মানুষ অদ্ভুত শব্দে গোঙায়, চিকার করে উঠে- পাশে থেকে কেউ ছুঁয়ে দিলে বা ডেকে দিলে এর আছর কেটে যায় মানে বোবা পালিয়ে যায়!
অনেকে একে বলে, চেপে বসা ভূত— এরা খুব ভারী, ঠান্ডা, এবং পঙ্গু করে ফেলতে ওস্তাদ। এদের ব্যাপারটা অনেকটা পানির মতো। যখন যে পাত্র যাবে তখন সে পাত্রের আকার ধারণ করবে। মানব সমাজের বিশ্বাস বোবা সাধারণত আছর করে- পানির কাছে ঘুমালে, বিছানায় পেছন ফিরে শুলে অথবা অপরিচ্ছন্ন বিছানায় ঘুমালে!
বোবাকে নিয়ে আরো বিস্তারিত খুব শীঘ্রই আপ করা হবে!
টাকরি / ট্যাওর
শিশু ভূত
৯) টাকরি বা ট্যাওর ভূত হলো সেইসব শিশুদের আত্মা, যারা জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই (সাধারণত ১৫ দিনের মধ্যে) মারা গেছে।
লোককথা অনুযায়ী, অপুষ্টি, অবহেলা বা অজ্ঞাত কারণে মারা যাওয়া এই শিশু আত্মাগুলো পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারে না। এরা রয়ে যায় মাঝখানে— মৃত্যু ও জীবনের সীমারেখায় আটকে থাকে এরা।
তাই এদের অন্য নাম শিশু ভূত।
এই ভূতেরা সাধারণত আতুরঘর, লেবার ওয়ার্ড কিংবা হাসপাতালের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। এদের মূল লক্ষ্য জীবিত নবজাতক। অনেকে বিশ্বাস করে, সুযোগ পেলেই এরা মায়ের কোল থেকে নবজাতক শিশুকে চুরি করে নিয়ে যায়, রক্তপান করে তাদের হত্যা করে।
টাকরির চেহারায় থাকে এক ধরনের ধোঁয়াশা-ভরা নির্মলতা। এরা ধবধবে ফর্সা, কিন্তু সেই ফর্সা রঙে নেই কোনো উষ্ণতা— বরং থাকে এক ধরনের মৃত্যুর ছোঁয়া হিম ঠান্ডা। এরা সুর করে কাঁদে—টাকরি টাকরি করে, যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো শিশুর আর্তি। আবার মাঝে মাঝে খিক খিক করে হেসে উঠে। যা শুনলে গা শিউরে ওঠে।
অনেক নারী, বিশেষ করে প্রসূতি মায়েরা স্বপ্নে বা ঘুম ভাঙার মুহূর্তে টাকরি ভূতকে দেখার দাবি করে। অনেকে বলে তারা হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন শিশুটি নেই, পরে কোথাও পড়ে আছে, ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার কেউ বলেন, কে যেন শিশুর গায়ে হালকা হাত বুলিয়ে যাচ্ছে— মায়ের বুকের দুধের গন্ধে বিভোর এক আকুল আত্মা।
যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান বলে, টাকরি হয়তো এক ধরনের মানসিক ট্রমার প্রতিফলন। নবজাতক হারানোর শোক, প্রসব-পরবর্তী অবসাদ, দুঃস্বপ্ন, কিংবা গভীর অনুশোচনা এই বিশ্বাসগুলোর জন্ম দিতে পারে।
টাকরি ভূত মূলত আমাদের গভীর মানসিক ভয়াবহতাগুলোর প্রতীক। এখানে আছে শিশুমৃত্যুর বেদনা, নারীর মাতৃত্বভীতি, এবং সেইসাথে বেঁচে থাকার দায়ভার থেকে জন্ম নেওয়া অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা। লোককথা যতই ভয়ের হোক না কেন, টাকরি এক গভীর করুণার নাম— অনাদরে ঝরে যাওয়া একটি ছোট্ট প্রাণের স্তব্ধ বিলাপ।
মেছো
১০) মেছো-ভূতের নামটি এসেছে মাছ শব্দ থেকে, যার অর্থ– যে ভূতের মাছের প্রতি প্রবল আসক্তি। বাংলার গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, মেছো ভূত হচ্ছে এক ধরনের আত্মা, যাদের মৃত্যুর পরও মাছ খাওয়ার লোভ মেটেনি। জীবদ্দশায় তারা হয়তো ছিল মাছপ্রেমী—জেলে, মাছুরে, কিংবা কারও রান্নার সঙ্গী।
মেছো ভূতরা সাধারণত বসবাস করে পুকুরপাড়, নদীতীর, বিল, লেক বা গ্রামীণ বাঁশঝাঁড়ের আশেপাশে, যেখানে মাছ সহজলভ্য। রাতে, বা সন্ধ্যাবেলায় এরা সক্রিয়। বাজার থেকে মাছ কিনে কেউ গ্রাম্য রাস্তায় ফিরলে, সেই ব্যক্তি যদি একা থাকে—তাকে মেছো ভূত অনুসরণ করে।
পথের এক নির্জন বাঁকে, বাঁশঝাড় কিংবা গাছের আড়াল থেকে মেছো-ভূত হঠাৎ করে ভেসে উঠে, ভয় দেখায়, অথবা একেবারে চুপিসারে মাছের থলেটা ছিনিয়ে নেয়। কেউ কেউ দাবি করে—মেছো ভূত নাকি হঠাৎ বাতাসের ঘূর্ণি তুলে, থলে ছিঁড়ে মাছ নিয়ে চম্পট দেয়। কেউ আবার বলে—সাদা ধবধবে একটি মুখ হাসতে হাসতে ভেসে উঠে, শুধু মাছ নিয়েই উধাও হয়ে যায়।
মেছোর শুধু রাস্তায় নয় লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এরা মাঝেমাঝে রান্নাঘরে এসে কাঁচা বা রান্না করা মাছও চুরি করে নেয়। আবার জেলেদের নৌকাতেও হানা দেয়, বিশেষ করে যখন নৌকাগুলো বিলের ধারে ভিড়িয়ে রাখা হয়, কিংবা রাতে তীরে বাঁধা থাকে।
মেছোর নির্দিষ্ট রূপ নেই, তবে অনেকেই বলে এরা হালকা ধোঁয়াসম আকৃতি ধারণ করে। কখনো শিশুর গড়নে, আবার কখনো বৃদ্ধের রূপে উদয় হয়। কেউ কেউ বলে, এদের মুখে একধরনের হাসি লেগে থাকে এবং এরা মাছে-ভাতে বাঙালির মতোই মাছের গন্ধে ছুটে আসে।
মেছোর কাহিনী মূলত মানুষের মাছ চুরির ঘটনাকে অলৌকিক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর উপায়। কিংবা শিশুদের রাতে একা মাছ আনতে না পাঠানোর সতর্কতা। আবার এমনও হতে পারে, এই ভূতের ধারণা তৈরি হয়েছে সেইসব গরিব বা বঞ্চিত মানুষদের আত্মার প্রতীক হিসেবে, যাদের মৃত্যুর পরও পেট ভরে মাছ খাওয়ার সাধ অপূর্ণ রয়ে গেছে।
মেছো কোনো ভয়ানক, রক্তচোষা ভূত নয়। বরং সে এক লোভী, মাছপ্রিয়, এবং কখনো কখনো দুষ্টু আত্মা। বাংলার লোককথায় এর অবস্থান মিশ্র—ভয় আর মজার মাঝামাঝি। তার গল্পে আছে গ্রামীণ প্রাণ, গন্ধে ভরা মাছবাজার, আর কল্পনার এক রকম খিদে।

একটা বিষয় না বললেই নয়, বাংলাদেশের লিটল ম্যাগগুলোয় কিংবা স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রকাশনাগুলোয় এর বহুবিধ সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। অন্তত আমি পেয়েছি। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন কবির লেখায় ‘র’ ফর্মকে প্রকটভাবে দেখা যায়। তাহলে কি হাংরিকে একটা সচল মুভমেন্ট বলা যেতে পারে? অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, হ্যাঁ। কারণ হাংরির বুলেটিন, প্রকাশান যে কেউ করবার এখতিয়ার রাখতেন। তাছাড়া হাংরি কোনো প্রাইভেট প্রোপার্টি ছিল না। যেমনটা আমাদের ব্রিটিশ বেনিয়ারা শিখিয়েছিলেন। পশ্চিমের চাপানো অবয়বকে রূঢ়ভাবে ভাঙচুর করবার একটা পায়তারা ছিল। ছিল আপনাকে তুলে আনবার ইচ্ছা!
তবুও মনের কোণে অসংখ্য প্রশ্ন থেকেই যায়। হাংরি মুভমেন্টের কিংবদন্তী মলয় রায়চৌধুরীর কাছ থেকেই জানতে চাই সেসব প্রশ্নের উত্তর। তাই বোকাবিডির হয়ে মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী স্বাধীন। বোকা ধারণা করে মলয় রায় চৌধুরীর জীবদ্দশায় এটিই হয়তো তার শেষ সাক্ষাৎকার। তাই বোকা কোনো কর্তন আর সংশোধন ছাড়াই পুরোটাই প্রকাশ করেছে। সাক্ষাৎকারটি বোকা সকলকে সমৃদ্ধ করবে। পড়তে এই ক্লিক করুন- মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
আলেয়া
১১) আলেয়া বাংলার লোকবিশ্বাসে একটি রহস্যময় ও প্রতীকী ভূত, যাকে সাধারণত দেখা যায় জলাভূমি, বিল, হাওড়, কিংবা নদীঘেরা এলাকায়। এটি অন্য ভূতের মতো স্পষ্ট কোনো মানবাকৃতির নয়, বরং ধোঁয়ার মতো, কুয়াশার মতো অস্পষ্ট, দপদপে আলো বা ভাসমান আগুনের মতো আবছা এক সত্তা। বিশেষ করে রাতে, যখন কুয়াশা জমে বা বাতাস ভারী থাকে, তখন হঠাৎ করেই আলেয়ার আবির্ভাব হয়। মানুষের চোখে এগুলো দূর থেকে জ্বলজ্বল করা নীলচে আলো বা ধোঁয়ার মতো ভাসমান কিছু, যা এক জায়গায় স্থির থাকে না—বারবার জায়গা বদলায়, যেন কারো দৃষ্টি টানতে চায়।
আলেয়ার মূল কাজ হলো মানুষকে, বিশেষ করে জেলেদের বা পথিকদের, বিভ্রান্ত করা। অনেক জেলে বা মাঝি বলেন—আলেয়ার আলো দেখে তারা ভুল পথে চলে যান এবং গভীর পানিতে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারান। এমনকি, তাদের জালও কখনো কখনো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায় বা কেটে পড়ে—লোকেরা বিশ্বাস করে এটি আলেয়ার কাজ। মনে করা হয়, আলেয়ারা ধোঁয়ার আড়ালে থেকে জাল চুরি করে এবং লোকজনকে গভীর জলে টেনে নিয়ে যায়। এই ভূতের ভয় এমনই যে, অনেকে রাতের দিকে জলাভূমিতে যেতে ভয় পান, বিশেষ করে নৌকা নিয়ে একা গেলে।
তবে আলেয়া কেবল অশুভ নয়, বরং দ্বৈতপ্রকৃতির এক চরিত্র। লোককথায় জানা যায়, অনেক সময় আলেয়া বিপদের পূর্বাভাস হিসেবে উপস্থিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বড় ঝড়, বজ্রপাত, বা নদীতে বিপদ আসার আগে কেউ কেউ আলেয়ার আলো দেখে সাবধান হন এবং প্রাণে বাঁচেন। এই দিক থেকে আলেয়া একরকম সতর্কবার্তাও হতে পারে—যে কখন কোথায় বিপদ আসতে পারে, তা বাতাসের মতো আভাস দেয়। কেউ কেউ বিশ্বাস করে, কিছু আলেয়া আসলে মৃত জেলেদের আত্মা, যারা জীবিতদের সাহায্য করতে ফিরে আসে।
আলেয়া তাই শুধু ভূত নয়, বরং বাংলার নদীমাতৃক সমাজে ভয় ও অভিজ্ঞতার এক প্রতীক। এটি জলজ পরিবেশে বেঁচে থাকা মানুষের দৈনন্দিন ঝুঁকি, আবহাওয়ার ভয়, এবং প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি শ্রদ্ধার মিশ্রণ। আলেয়ার কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সব ভূত হিংস্র নয়, কেউ কেউ হয়তো শুধু পথ দেখাতেই আসে, অদ্ভুত এক রূপে, যাকে আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
গেছো
গেছোভূত বাংলার লোককথায় অন্যতম পরিচিত ও ভয়াবহ এক ভূতের প্রজাতি। এদের আবাসস্থল কোনো পরিত্যক্ত, পুরোনো বা ঘন ডালপালাওয়ালা গাছ। সাধারণত গ্রামবাংলায় বটগাছ, পাকুড়গাছ, তালগাছ, কিংবা বনে-জঙ্গলে ছায়া ঘেরা পুরনো গাছকে কেন্দ্র করে গেছোভূতের বাসস্থান বলে বিশ্বাস করা হয়। দিনের বেলায় এরা নীরব থাকে, তবে সন্ধ্যার পরে কিংবা গভীর রাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক সময় লোকেরা দেখে গাছের কোনো এক ডালে এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি বসে আছে, কখনো তা নড়াচড়া করে, আবার কখনো অদৃশ্য হয়ে যায়। কেউ কেউ বলে, গেছোভূতের চোখ লালচে হয় এবং সে নিঃশব্দে হেসে ওঠে।
১২) এই ভূত মূলত মানুষকে ফাঁদে ফেলার জন্য নানা রূপ ধারণ করে। বিশেষ করে কিশোর বা কিশোরীদের টার্গেট করে যারা রাতে বাইরে থাকে বা খেলতে খেলতে গাছের কাছাকাছি চলে যায়। গেছোভূত অনেক সময় সুন্দর পাখির ডাক নকল করে বা গাছে ঝলমলে ফল-ফুলের প্রলোভন দেখায়। কেউ সে লোভে গাছে উঠলে, হঠাৎ ডাল ভেঙে পড়ে যায় বা ভূত নিজে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় নিচে। অনেক ক্ষেত্রে গেছোভূত নিজেই ছায়ামূর্তি হয়ে গাছের ডালে বসে থাকে, আর অসতর্ক মানুষকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দেয়। ফলে আহত বা অচেতন হয়ে অনেক সময় প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
গেছোভূত সাধারণত মানুষকে মেরে ফেলার ইচ্ছা থেকে নয়, বরং একটি অদ্ভুত মজা বা শত্রুভাবাপন্ন কৌতুকে ফাঁদে ফেলে। অনেক সময় তারা কিশোর-কিশোরীদের নাম ধরে ডাকে, এমনভাবে যেন খুব পরিচিত কেউ ডাকছে। কেউ সাড়া দিলে বা গাছের দিকে এগোলে বিপদে পড়ে। এই ভূতের আচরণ অনেকটা কপট, প্রতারণাপূর্ণ ও শিশুসুলভ দুষ্টুমির মতো হলেও এর ফল হয় অনেক ভয়াবহ।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গেছোভূত থেকে রক্ষা পাওয়ার কিছু পদ্ধতি রয়েছে। যেমন—গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে যাওয়া, গাছে উঠার আগে তিনবার ‘বিসমিল্লাহ’ বলা, বা গাছের গোড়ায় লবণ ছিটিয়ে চলা। আবার অনেকে বলেন, গেছোভূতের ভয় থাকলে শিশুর গলায় কালো সুতা পরাতে হয় বা লাল টিপ দিয়ে额মুখ চিহ্নিত করতে হয়।
গেছোভূত তাই বাংলার লোককাহিনিতে একদিকে যেমন ভয়ের প্রতীক, অন্যদিকে এক রকম প্রাকৃতিক সতর্কবার্তাও বটে—সবসময় প্রলোভনে পা দিলে বিপদ হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে এক ধরনের শৈশব আতঙ্ক, ছায়ার প্রতি ভয়, আর অজানার প্রতি মানুষের সহজাত কৌতূহলের কাহিনি। গেছোভূতের গল্প আজও বাংলার বাচ্চাদের ঘুমোবার আগের চুপচাপ শোনা গা-ছমছমে একটি ছায়া।
কাঁদরা-মা
১৩) কাঁদরা-মা বা শুধুই কাঁদরা, বাংলার গ্রামীণ লোককথায় এক গভীর শোক আর ছলনার ভূত। এটি এক নারীস্বরূপ ভূত, যে সাধারণত গ্রামের পাশের নির্জন জঙ্গল, বাঁশঝাড়, বা ধানের মাঠঘেরা বনাঞ্চলে বসে করুণ সুরে বিলাপ করতে থাকে। সেই কান্নার সুর এতটাই হৃদয়বিদারক ও মানবিক যে, কেউ যদি রাতে বা সন্ধ্যার পর সেই কান্না শুনে ফেলে, সে মনে করে, নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়া মানুষ বা শিশু-কান্না। কাঁদরার কণ্ঠস্বর বিশেষত মায়াবী, স্তব্ধ গ্রাম্য রাতের কোলাহলে এক ধরনের টান তৈরি করে, যা অবচেতনভাবে শুনলেই সাহায্য করতে ইচ্ছে করে।
কাঁদরা-মার প্রধান কৌশলই হলো এই বিলাপ দিয়ে মানুষের সহানুভূতি টেনে নেওয়া। সে কখনো মায়ের মতো ডাকে—”আমায় বাঁচাও”, কখনো শিশুর মতো কেঁদে বলে—”আমি হারিয়ে গেছি”। কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে সে ধীরে ধীরে কথা বলে, কান্নার গল্প শোনায়, আর মানুষটিকে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে যায়। একবার কেউ তার ফাঁদে পড়লে, আর সহজে ফিরে আসে না। বিশেষত ছোট শিশুরা এই মায়াবী কান্নায় বেশি আকৃষ্ট হয়, কারণ তাদের সরল মন ও কল্পনা কান্নাকে সত্যি ভেবে ফেলে। অনেক শিশুর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে লোকেরা কাঁদরার হাত রয়েছে বলে বিশ্বাস করে।
লোকবিশ্বাসে, কাঁদরা-মা সেইসব নারী বা মায়েদের আত্মা—যারা হয়তো সন্তান হারিয়ে, নিঃসঙ্গতায়, বা নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। তারা জীবিত অবস্থায় এতটাই শোকবিহ্বল ছিলেন যে, মৃত্যুর পরও সেই কান্না থামেনি—বরং হয়ে উঠেছে প্রতিশোধ আর ছলনার অস্ত্র। কাঁদরা-মা বাংলার লোকবিশ্বাসে তাই একদিকে শোকের প্রতীক, আবার অন্যদিকে এক অতৃপ্ত নারীর প্রতিশোধস্পৃহা। তার কান্না শুনে যাওয়া মানেই বিপদের দিকেই পা বাড়ানো—যেখানে সহানুভূতি, ভয় ও অন্ধকার মিলেমিশে এক মৃত্যু-ফাঁদে রূপ নেয়।
কানাখোলা
১৪) কানাখোলা ভূত বাংলার লোকবিশ্বাসে এক রহস্যময় এবং বিভ্রান্তিকর ভূত, যার কাজ মানুষকে পথভ্রষ্ট করা। সাধারণ ভূতেরা যেখানে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে, কানাখোলা তার চেয়ে অনেক বেশি ছলনাময়। এ ভূতের প্রধান অস্ত্র হলো—ভ্রম সৃষ্টি করা, যেন মানুষ নিজেই নিজের গন্তব্য ভুলে যায়। সাধারণত গ্রাম বা শহর থেকে দূরে, চর, বালুচর, নদীর ধারের ফাঁকা জায়গা বা বাঁশঝাড়ে এই ভূতের বিচরণ।
যখন কেউ একা, গভীর নির্জন স্থানে হাঁটে, তখন কানাখোলা ভূত তাকে লক্ষ্য করে। হঠাৎই মনে হয় সে পথ হারিয়ে ফেলেছে, চারপাশ একইরকম লাগছে, এমনকি সে একই জায়গায় বারবার ফিরে আসছে। এই ভূতের ফাঁদে পড়লে মানুষ এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ে—যেখানে সময়, দিক আর জায়গার অনুভব সব গুলিয়ে যায়। সে যতই সামনে এগোতে চায়, মনে হয় পিছনে যাচ্ছে বা গোলচক্রে ঘুরছে।
অনেক সময় মানুষ বলে—পায়ের নিচে নরম বালি, কুয়াশার পর্দা, বা হঠাৎ গা ছমছমে বাতাসের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, যেন কোনো কিছু তাকে চোখ বেঁধে ঘোরাতে শুরু করে। এই অবস্থায় যদি দ্রুত উদ্ধার না হয় বা কেউ তার নাম ধরে না ডাকে, তবে সেই ব্যক্তি ক্লান্ত হয়ে, পানি বা খাদ্যের অভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোয়। এমনকি কেউ কেউ বলে, বহু নিখোঁজ ব্যক্তির পেছনে কানাখোলা ভূতের হাত রয়েছে।
কানাখোলা থেকে বাঁচতে লোকেরা বলে, সঙ্গে লবণ, লোহার টুকরো, কিংবা পিয়াজ রাখলে ঘোর কেটে যায়। আবার নিজের জুতা বা চপ্পল পাল্টে উল্টো পরে হাঁটলে নাকি ভ্রম কাটে। এই ভূতের গল্পগুলো শুধুই অলৌকিক নয়, বরং প্রকৃতিতে মানুষের অসহায়ত্ব, দিশাহীনতা আর একাকীত্বের গভীর প্রতিচ্ছবি।
চোরাচুন্নি- দুষ্ট ভূত
১৫) চোরাচুন্নি বাংলার লোকবিশ্বাসে একধরনের দুষ্ট ভূত, যাদের উৎপত্তি হয় চুরি করে মারা যাওয়া নারী-পুরুষদের আত্মা থেকে। নারী চোর মরলে সে হয় “চুন্নি”, আর পুরুষ চোর হলে সে হয় “চোরাচুন্না”। এই ভূতেরা সাধারণ আত্মাদের মতো শান্ত নয়—তারা মৃত্যুর পরও চুরির প্রবৃত্তি ছাড়তে পারে না। ফলে, তারা জীবিত মানুষের ঘরে অদৃশ্যভাবে ঢুকে পড়ে, জিনিসপত্র নষ্ট করে, ভয়ভীতি ছড়ায়।
বিশেষত পূর্ণিমা রাতে চোরাচুন্নিদের গতি বাড়ে বলে বিশ্বাস করা হয়। তারা সাধারণত বাড়ির অন্ধকার কোণ, চালাঘর, বা রান্নাঘরে লুকিয়ে থাকে এবং লোকজন ঘুমিয়ে পড়লে নড়াচড়া করে। কেউ কেউ বলেন, তারা গন্ধ ছড়িয়ে দেয়, পায়ের শব্দ হয়, বা বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসে, যেটা তাদের উপস্থিতির ইঙ্গিত। কখনো কখনো ঘরের জিনিসপত্র নিজে নিজে পড়ে যায় বা অদৃশ্য হয়ে যায়—লোকেরা বিশ্বাস করে, এটা চোরাচুন্নির কাজ।
এই ভূত ঠেকাতে অনেকে বাড়ির সামনে গঙ্গাজল ছিটায়, কেউ আবার তুলসী গাছের নিচে ধূপ জ্বালায়। পুরনো বাড়িতে যেখানে চোরের সন্দেহে কেউ মারা গেছে, সেখানে বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হয়। চোরাচুন্নি তাই শুধু এক ধরনের অশরীরী নয়, এটি মানুষের অপরাধবোধ, ভয় এবং শাস্তির ধারণা থেকেও জন্ম নেওয়া এক কল্পিত প্রতিশোধের প্রতীক।
পেঁচাপেঁচি
১৬) পেঁচাপেঁচি বাংলার লোককাহিনির এক ভয়ঙ্কর ও রহস্যময় ভূতের জোড়া—যাদের নাম এসেছে পেঁচা পাখির নাম থেকে। পেঁচা যেমন রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে উড়ে বেড়ায়, তেমনি এই ভূতজোড়াও নীরবে শিকার করে। “পেঁচা” হলো পুরুষ, আর “পেঁচি” হলো স্ত্রী ভূতের রূপ। লোকবিশ্বাসে, এরা সাধারণত জোড়ায় থাকে এবং কখনো একা আক্রমণ করে না। বাংলার ঘন জঙ্গল, পাহাড়ি পথ, কিংবা পুরনো শ্মশান–এইসব স্থানে তাদের উপস্থিতি ধরা পড়ে, বিশেষ করে যেখানে দুর্ভাগা বা একাকী ভ্রমণকারী চলাফেরা করে।
পেঁচাপেঁচি এক অদ্ভুত শিকারী ভূত। তারা ধীরে ধীরে মানুষকে অনুসরণ করে, কিন্তু সরাসরি সামনে আসে না। দূর থেকে এক ধরনের মৃদু ফিসফাস, পেঁচার ডাক বা বাতাসে নড়াচড়ার শব্দ করে আতঙ্ক ছড়ায়। কোনো মানুষ একা হলে বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা শিকারের শরীর চেপে ধরে এবং ভ্যাম্পায়ারের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাংস খায়—প্রচলিত বিশ্বাস এমনটাই বলে। কখনো কখনো মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায় না, যেন তারা পুরোপুরি গ্রাস করে নেয়।
এদের মুখোমুখি হওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু—এমনটাই মনে করেন গ্রামীণ বৃদ্ধরা। কারো গলায় লোহা বা রূপা থাকলে, বা কেউ পেঁচাপেঁচির নাম মুখে না আনলে হয়তো রক্ষা পাওয়া যায়। যদিও আধুনিক যুগে এদের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, তবুও অনেকেই বলেন, বাংলার রাতঘেরা অরণ্যে কোথাও এখনো পেঁচাপেঁচি জেগে থাকে, শিকারের অপেক্ষায়।
বেঘোভূত
১৭) বেঘোভূত বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের, বিশেষ করে সুন্দরবনের গা ছমছমে লোককথায় বারবার উঠে আসা এক ভয়াল চরিত্র। কথিত আছে, যারা বাঘের আক্রমণে মৃত্যু বরণ করেছে, তাদের আত্মাই হয়ে ওঠে বেঘোভূত। এই ভূতেরা মানুষকে ভয় দেখায় না শুধু, তারা এক ধরনের অভিশপ্ত বিভ্রান্ত আত্মা, যারা জীবিতদেরকেও একই পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে চায়। সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলে, যেখানে বাঘের হুঙ্কার ভেসে আসে, সেখানে কেউ নিঃসঙ্গ হলে—লোকেরা ভাবে, বেঘোভূতের নজরে পড়েছে সে।
এই ভূতের ভয়ের ধরন একটু ভিন্ন। তারা সরাসরি আক্রমণ করে না, বরং ভয়, বিভ্রান্তি আর বাঘের সুরে কান্না করে মানুষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। অনেক সময় বাঘের মতো গর্জন করে, আবার কখনো গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে এক ধরনের করুণ হুঙ্কার শোনা যায়, যা শোনামাত্র শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। কেউ কেউ বলে, তারা অদৃশ্য হাত ধরে টেনে নেয় বা চেনা পথ ভুলিয়ে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যায়, যেখানে বাঘ ও মৃত্যু ঘাপটি মেরে বসে।
মৌয়াল, বাওয়াল বা মধু সংগ্রাহকরা এই ভূতের ভয়ে অনেক সময় জঙ্গলে একা ঢোকে না। তারা সঙ্গে তাবিজ, মন্ত্রপড়া গাছের ডাল বা গঙ্গাজল নিয়ে যায়, যেন বেঘোভূতের প্রভাব না পড়ে। এ ভূতের নাম শুনলে অনেকের বুক কাঁপে, কারণ এর পেছনে আছে বাস্তব মৃত্যু আর নিখোঁজ হওয়ার ভয়ানক অভিজ্ঞতা। কারো জুতা মেলে জঙ্গলের ভেতরে, কিন্তু মানুষ আর ফেরে না—তখন লোকেরা বলে, “বেঘোভূত নিয়া গেছে।”
বেঘোভূতের কাহিনি শুধু অলৌকিক নয়, বরং সুন্দরবনের অ্যাডভেঞ্চার, শিকারের ভয়, প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা এবং মানুষের অসহায়ত্ব মিলিয়ে এক গা শিউরে ওঠা প্রতীক। এটা এক রকম সতর্কবার্তা, যেন মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মকে সম্মান করে, না হলে তার ভয়াল জবাব অপেক্ষায় থাকে… হয়তো কোন একটা গাছের আড়ালে, বেঘোভূতের ছায়ায়।
দেও
শুক্রবার বা অমাবস্যার দিন দেওরা বেশি সক্রিয় থাকে
১৮) দেও এমন এক ভূতপ্রেত বা আত্মা, যাদের বাস নদী, লেক, পুকুর বা বিলের পানির নিচে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, বা নদীমাতৃক এলাকায় দেও-এর কাহিনী খুব পরিচিত। শব্দটি দৈত্য বা ডুবিয়ে মারা ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে অনেকে মনে করেন। এই ভূতকে কেউ জলের দৈত্য, কেউ নদীর আত্মা, আবার কেউ পানির ভূত বলে ডাকেন।
দেওদের দেখা মেলে গভীর নদীর ধারে, ভাঙনকবলিত জায়গায়, পুরনো ঘাট বা নির্জন জলাশয়ে। তারা থাকে পানির নিচে—অদৃশ্য, নিশ্চুপ, কিন্তু সবসময় প্রস্তুত শিকার ধরতে। দেওদের প্রধান কাজ হলো—লোকজনকে পানিতে টেনে ফেলা, ডুবিয়ে মারা, এবং অনেক সময় নিখোঁজ করে দেওয়া। তারা সাধারণত একাকী স্নান করতে আসা নারী বা শিশুদের টার্গেট করে।
মাঝেমাঝে তারা ডুবন্ত কণ্ঠে নাম ধরে ডাকে, এবং যে সাড়া দেয়, তাকে টেনে নেয় নিচে। কেউ কেউ বলে, তারা শীতল বাতাসের মতো গা বেয়ে ওঠে, আর হঠাৎ পা পিছলে গিয়ে মানুষ পড়ে যায়।
দেওদের দেহ সাধারণত দেখা যায় না, তবে কেউ কেউ বলে তারা কাদায় ঢাকা, জলছাপ ভেজা, এবং গন্ধহীন এক সত্ত্বা। কোনো কোনো গল্পে তারা অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক মাছ, আবার কারো মতে, মাছের মতো পিচ্ছিল দেহে মানুষের হাত।
গ্রামীণ মায়েরা সাধারণত বাচ্চাদের একা নদীতে যেতে বারণ করতে বলে— একলা নদীতে যাস না, দেও টেনে নিয়ে যাবে।
তারা বিশ্বাস করেন, শুক্রবার বা অমাবস্যার দিন দেওরা বেশি সক্রিয় থাকে।
কেউ কেউ দেওকে ঠেকাতে লেবু, লাল কাপড় বা ছ্যাঁকা তেল নদীতে ছুঁড়ে দেন, যেন আত্মা তুষ্ট থাকে।
দেও হওয়ার পেছনে কিছু লোককাহিনী আছে: কেউ অপঘাতে ডুবে মারা গেছে, কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছে, কেউ হয়তো নৌকাডুবির শিকার, যাদের দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি—তারা হয়তো জলেই রয়ে গেছে- এরাই মূলত দেও হয়।
দেও ভয়ের প্রতীক, যা মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অজানা গভীরতা ও জলের রহস্য থেকে জন্ম নিয়েছে। নদী যেমন জীবন দেয়, আবার হঠাৎ কেড়ে নেয়— দেও সেই বিপদের প্রতীক, যাকে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
ডাইনী
পশ্চিমা সমাজে ডাইনী একটা অপবাদ হিসাবেও পরিচিত। ইতিহাস বলে- ডাইনী অপবাদ দিয়ে বহু নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে পশ্চিমা দেশে। ডাইনীর গল্প কেবল অলৌকিক নয়, বরং এটি নারী নিপীড়নের, কুসংস্কারের, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার এক প্রতীক।
১৯) ডাইনী কোনো আত্মা নয়, বরং লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এক ধরনের জীবিত নারী—বিশেষত এমন বৃদ্ধা মহিলা, যারা কালো জাদু, ওঝা বিদ্যা, তান্ত্রিকতা বা ডাকিনীবিদ্যায় পারদর্শী। বাংলার লোকসাহিত্যে ডাইনী এক ভয়ংকর ও অভিশপ্ত সত্ত্বা, যাকে সাধারণত সমাজের বাইরে বা প্রান্তিক নারীদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
ডাইনী শব্দটির শাব্দিক অর্থ পশ্চিমা শব্দ witch এর সমতুল্য হলেও, এর বাংলা সংস্করণটি অধিকতর গ্রামীণ, কুসংস্কারপ্রবণ ও সামাজিকভাবে নিপীড়িত এক চিত্র ধারণ করে।
ডাইনী সাধারণত বৃদ্ধা, কৃশকায়, ছেঁড়া শাড়ি পরিহিত, এবং তার চোখে থাকে অদ্ভুত জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। তারা একাকী থাকে— কখনো বাঁশঝাড়ের পাশে, জঙ্গলের ধারে কিংবা গ্রামের প্রান্তে ভাঙা কুঁড়ে ঘরে। লোকেরা বলে, সন্ধ্যার পর তাদের বাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হয়, কখনোবা অদ্ভুত গন্ধ। লোকবিশ্বাসে মতে— ডাইনীরা ছোট শিশুদের অপহরণ করে, তাদের জাদুটোনায় মেরে রক্ত পান করে, আর সেই রক্তের মাধ্যমে নিজেদের জীবন ১০০ বছর বা তার বেশি পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়। তারা সরাসরি আক্রমণ করে না বরং রাতে, ঘুমের ঘোরে বা অসুস্থ অবস্থায় শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে যায়।
ডাইনীদের নিয়ে বিশ্বাস আছে তারা— মানুষের রোগ ধরাতে পারে, ফসল শুকিয়ে দিতে পারে, জ্বীন বা আত্মাকে কাবু করতে পারে, এবং যেকোনো পরিবার ধ্বংস করতে পারে, যদি তাদের খুশি না রাখা হয়।
গ্রামীণ সমাজে অনেক লক্ষণ দেখে ডাইনীকে নির্ধারণ করা হয়।
চেহারায় বিরক্তিকর দৃষ্টি বা বড় চোখ, দীর্ঘ একাকীত্বে থাকা, প্রতিবেশীদের সাথে মিশতে না চাওয়া, ঘরের পাশে পেঁচা বা চিল দেখতে পাওয়া। হঠাৎ শিশু অসুস্থ হওয়া- এসবই ডাইনী হওয়ার সন্দেহ বাড়ায়।
পশ্চিমা সমাজে ডাইনী একটা অপবাদ হিসাবেও পরিচিত। ইতিহাস বলে- এমন অপবাদ দিয়ে বহু নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে পশ্চিমা সমাজে।
ডাইনীর গল্প কেবল অলৌকিক নয়, বরং এটি নারী নিপীড়নের, কুসংস্কারের, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার এক প্রতীক। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে—একাকী, স্বামীহারা, নিঃসন্তান বা প্রতিবাদী নারীদের ডাইনী তকমা দিয়ে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অর্থাৎ, ডাইনী কখনও এক বাস্তব নারী, আবার কখনও সমাজের আতঙ্কের ছায়া।
ডাইনী আসলে সেই নারীর প্রতীক— যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভিন্ন চিন্তা করে, যে সমাজের নিয়ম মানে না, যে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, আর তাই সে হয়ে ওঠে সমাজের চোখে ভীতিকর, অপবিত্র, নিষিদ্ধ।
শকসো / শক্শ
২০) শকসো যাকে কিছু এলাকায় শক্শ নামেও ডাকা হয়। এটি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকবিশ্বাসে বিশেষভাবে পরিচিত এক ভূতপ্রেত। এই ভূতের নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মত রয়েছে— কেউ বলে শক মানে ঝাঁকুনি বা আঘাত, আবার সো বা শ থেকে এসেছে শরীর বা শর্ট (ঝটকা)। একে বাংলার আক্ষরিক ‘চর মারা ভূত’ বললে খুব একটা ভুল হবে না।
শকসো ভূতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো— এরা মুখোমুখি সাক্ষাতে দেখা দেয় না, বরং আচমকা পেছন থেকে তীব্র আঘাত করে। সাধারণত নিরিবিলি এলাকা— বসতবাড়ির পাশে ছোট জঙ্গল, ধানক্ষেতের ভেতরের রাস্তা আইল, গাছপালার আড়াল, বা পুরনো বাঁশঝাড়— এইসব জায়গা তাদের প্রিয় বিচরণক্ষেত্র।
এই ভূত মধ্য দুপুর বা ঠিক সন্ধ্যার মুখে সক্রিয় হয়। দুপুরের রোদ আর সন্ধ্যার কুয়াশা— এই দুটো সময়েই নাকি মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয়। সম্ভবত তখন আশেপাশে কেউ না থাকায় এরা নির্ভয়ে হানা দিতে পারে।
শকসোর আক্রমণ হয় দ্রুত, অদৃশ্য ও প্রচণ্ড শক্তির সঙ্গে। হঠাৎ পিঠে প্রচণ্ড একটা চড় পড়ে—দগদগে, জ্বলুনি নিয়ে। অনেক সময় মুখে বা বুকে চর মারা হয়।
আক্রান্ত ব্যক্তি তাৎক্ষণিক ব্যথায় চিৎকার করে উঠে, পড়ে যায় বা দিশেহারা হয়ে দৌড় দেয়।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো—আঘাতের জায়গায় হাতের ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে! অনেক সময় সে দাগ ২-৩ দিন পর্যন্ত থাকে।
অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তিরা জানান— তারা কিছুই দেখেননি, শুধু একটা হাওয়া বা শব্দ পেয়েছেন, তারপরেই ভয়ংকর ব্যথা!
গ্রামে এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, শকসো ভূতের আক্রমণ ঠেকাতে সঙ্গে লবণ, লোহা, বা আগুনে পোড়া কিছু রাখা ভালো। কেউ কেউ বলে— পিঠে আঘাত পাওয়ার পর দ্রুত নিজের কাপড় উল্টে পরে ফেললে ভূতের প্রভাব কাটে।
বয়স্ক নারীরা অনেক সময় পাটপাতা বা সরষে ছেঁকে তেল গরম করে সেই জায়গায় মালিশ করে, যাতে দাগ ও ব্যথা সারে।
শকসো ভূতের কাহিনী কেবল ভয় নয়, এটা বাংলার শরীর ও চেতনার অদৃশ্য আঘাতের প্রতীক। একধরনের মানসিক চাপ, ক্লান্তি বা হঠাৎ ট্রমার সঙ্গে এই বিশ্বাসের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক সময় বিকেল বা দুপুরে একা পথ চলতে গিয়ে মানুষের দেহ-মনে যে আতঙ্ক জন্মায় তা থেকেই এই শকসো বা শক্শ’র কাহিনীর জন্ম দিয়েছে।
শকসো / শক্শ এক ভয়ংকর, দ্রুতগামী, কিন্তু রহস্যময় ভূত। তার কোনো রূপ নেই, শব্দ নেই, কিন্তু তার চড়ের দাগ গায়ে থাকে—যেন সে বলে যাচ্ছে: “আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি আবার আসবো।”
ভূতের বর্তমান ভূতের ভবিষ্যৎ একটি - কাল্পনিক আলাপ
ভূতেরাও এখন রীতিমতো আধুনিক— কেউ ফেসবুকে ঘোরে, কেউ টিকটকে নাচে, কেউ আবার গভীর রাতে অ্যামাজন প্রাইমে পুরনো বাংলা ভূতের সিনেমা দেখে অভিমান করে কাঁদে।
বাঙালি ভূতের মধ্যে সবচেয়ে বেদনাহত প্রজাতি হলো “উচ্চশিক্ষিত অথচ উপেক্ষিত ভূত”—যারা একসময় কোচিং সেন্টারে ইংরেজি পড়াতো, এখন প্রবাসে প্রেতাত্মা হয়ে গুগল ট্রান্সলেট ঘাঁটে।
লিখন- “এদের না ভয় লাগে, না মায়া হয়—শুধু একরাশ দুঃখ ঘিরে থাকে। একেকটা ভূত যেন একটা হারিয়ে যাওয়া ফাইল, কেউ খোঁজ নেয় না।”
বোকা- “ভূতেরাও এখন ডিপ্লোম্যাটিক। কেউ কেউ নিজেকে ‘কনসাল্টিং স্পিরিট’ বলে পরিচয় দেয়।”
জানা গেছে, ভূতেরাও চাকরি খুঁজে!
লিখন- কয়েকজন তো ইউএনডিপিতে ‘আত্মা উন্নয়ন কর্মসূচি’র আবেদনও করেছে।
বোকা- তবে সবচেয়ে বিতর্কিত ভূত হলো “বিএনএসসি (বাংলাদেশ নন-সিলেবাস কাউন্সিল)” ভূত—যারা পুরনো প্রশ্নপত্র নিয়ে রাতের বেলা পড়ুয়াদের ঘাড়ের পাশে ফিসফিস করে: “এই প্রশ্ন কমন আসবে!”
লিখন- বঙ্গভূতের ইতিহাস আসলে বঙ্গীয় হাস্যরসের এক অনবদ্য সম্পদ—যা না বুঝে পাশ কাটিয়ে যাওয়া মানে নিজেরই আত্মাকে কিছুটা অবজ্ঞা করা।
বোকা- তাহলে কথা একটাই—
ভূত বাঁচাও, বাঙালির রসকৌতুক বাঁচাও।
লিখন- ঠিক ঠিক, ভূত বাঁচাও, বাঙালির রসকৌতুক বাঁচাও।
ভূত নিয়ে আমাদের পর্বটি এখানে সমাপ্ত হলেও- ভবিষ্যতে ভূতেদের নিয়ে আমরা একটা সভা করবো। সেই সভায় উপস্থিত থাকবেন- এই বিশ রকম পাসপোর্টধারী ভূতেদের মধ্যে মহামান্য ভূতেরা। কারণ আমরা খুব প্রকটভাবে লক্ষ্য করেছি ভূতেরা আমার লোক কৃষ্টি-কালচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরকে কোনোক্রমেই ভুলে যাওয়া যায়না এড়িয়ে যাওয়া যায়না। ভূতের সেই সভায় সবাইকে অগ্রিম আমন্ত্রণ!