হাংরি, খোলস ভাঙার প্রচণ্ড ইচ্ছা!

কথা চালিয়ে যাবার কথা বলে, সেই ষাটের দশকেই বুদ্ধি বেশ্যাদের গোড়ায় তীব্র আঘাত করেন হাংরিয়ালিস্ট কবি সাহিত্যিকরা। হাংরি মুভমেন্টের গতি প্রকৃতি থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া যায়, এক্টিভিস্টরা মুখোশের অবয়ব থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য সব ধরনের ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন। কী ভাষায় কী সামাজিক সন্ধিতে সব স্থানেই তারা তাদের আমি কে একটা বহুআমির প্রকৃতে উপস্থাপন করবার নিবিষ্ট চেষ্টা করেছেন। হাংরি মুভমেন্ট এতোটা দ্রুতই ছড়ায় যে তরুণরা প্রবলভাবে এতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কারণ, সে সময় পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্বেও বামপন্থী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শ্রমিকের ভাষা ঢং রংকে তারা নিজেদের সাহিত্যে প্রয়োগ করেনি। র ফর্মটা আসলে সবসময় উপেক্ষিত থেকে যায়। এই কাজটি প্রথম করেন হাংরিয়ালিস্ট সাহিত্যিকরা। অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্রদের যা কিছু এই বঙ্গে পাওয়া যায় কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় তা থেকে অন্তত এই বিষয়টিই স্পষ্ট হয়।

একটা বিষয় না বললেই নয়, বাংলাদেশের লিটল ম্যাগগুলোয় কিংবা স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রকাশনাগুলোয় এর বহুবিধ সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। অন্তত আমি পেয়েছি। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন কবির লেখায় ‘র’ ফর্মকে প্রকটভাবে দেখা যায়। তাহলে কি হাংরিকে একটা সচল মুভমেন্ট বলা যেতে পারে? অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, হ্যাঁ। কারণ হাংরির বুলেটিন, প্রকাশান যে কেউ করবার এখতিয়ার রাখতেন। তাছাড়া হাংরি কোনো প্রাইভেট প্রোপার্টি ছিল না। যেমনটা আমাদের ব্রিটিশ বেনিয়ারা শিখিয়েছিলেন। পশ্চিমের চাপানো অবয়বকে রূঢ়ভাবে ভাঙচুর করবার একটা পায়তারা ছিল। ছিল আপনাকে তুলে আনবার ইচ্ছা!

তবুও মনের কোণে অসংখ্য প্রশ্ন থেকেই যায়। হাংরি মুভমেন্টের কিংবদন্তী মলয় রায়চৌধুরীর কাছ থেকেই জানতে চাই সেসব প্রশ্নের উত্তর। তাই বোকাবিডির হয়ে মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান স্বাধীন।

পুরো সাক্ষাৎকারটি হুবুহু তুলে ধরা হলো।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি কি দাদাইজমের একটা নতুনরূপ?

মলয় রায়চৌধুরী: সমস্যা হলো যে বাংলাদেশে হাংরি আন্দোলনকারীদের বই বহুকাল যায়নি। এখন যাচ্ছে। তাও সবায়ের বই পৌঁছোয়নি। অনেকে ইনটারনেট থেকে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছেন। হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে। অর্থাৎ ষাট বছর আগে। অথচ বইপত্র পৌঁছোয়নি। তার মানে যিনি খবর পাচ্ছেন তিনি নিজের মনে ভাসাভাসা ধারণা গড়ে নিয়েছেন। ডাডা আন্দোলনের পর ইউরোপ-আমেরিকায় আরও বহু আন্দোলন হয়েছে, পশ্চিমবাংলাতেই হয়েছে নিম-সাহিত্য, শাস্ত্রবিরোধী, শ্রুতি ইত্যাদি আন্দোলন। এমনকি পরাবাস্তববাদ আন্দোলনকেও ডাডা আন্দোলনের নতুন রূপ বলা হয় না। ত্রিস্তান জারার রচনার সঙ্গে যেমন আঁদ্রে ব্রেতঁর রচনার ভাবনাধারার মিল নেই, তেমনই ওনাদের ভাবনাধারার সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকারীদের মিল নেই। তুমি ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত, সুভাষ ঘোষ, অরুণেশ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখের রচনা ডাডাবাদীদের পাশাপাশি রেখে পড়ে দেখতে পারো, তাহলেই টের পাবে। আমার প্রায় দুশোটা বই আছে, কবিতা, ছোটগল্প, স্মৃতিকথা, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ ইত্যাদি নিয়ে। এর মধ্যে কয়টা যে বাংলাদেশের পাঠকের কাছে পৌঁছেচে তা জানি না। তার ফলে অমন ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন অবশ্য ঢাকার কয়েকজন প্রকাশক আমাদের বই প্রকাশ করায় আগ্রহ দেখিয়েছেন। সংগ্রহ করে পড়লে স্পষ্ট হবে ধারণা।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি আন্দোলনকে কেন ইন জেনারেল ভিত্তি দেয়া যায়নি?

এখনো যে কবিতা আমাদের মন আর মগজকে আক্রান্ত করে, নিজেকে দাঁড় করায় নিজেরই প্রতিবিম্বের সামনে! মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার।

মলয় রায়চৌধুরী: ঠিক কী বলতে চাইছ বুঝতে পারলুম না। হাংরি আন্দোলন নিয়ে তো প্রচুর পিএইচডি আর এম ফিল হয়েছে, হয়ে চলেছে। ভারতের অন্যান্য ভাষায় এই আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা হয়েছে। কেবল আমার কবিতা নিয়েও একজন ডক্টরেট করেছেন। জার্মানিতে ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএই্চডি করেছেন হাংরি আন্দোলন নিয়ে। হ্যাঁ, বলা যায় যে বাণিজ্যিক প্রচার হয় না কেন! তার কারণ পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক রাজনীতি। তাছাড়া হাংরি আন্দোলনকারীরা কোনও সংবাদপত্রে আর রাজনৈতিক দলের আশ্রয় নিতে চায়নি। যারা নিয়েছে তাঁরা নিজেরাই আন্দোলন ত্যাগ করেছিলেন; যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ। বিনয় মজুমদার কিন্তু আন্দোলন ত্যাগ করেননি; একটা সাক্ষাৎকারে উনি আপশোষ করেছেন যে আন্দোলনের নেতা হবার কথা ছিল ওনার কিন্তু ওনাকে নেতা করা হয়নি। ওনার ভুট্টা সিরিজের কবিতাগুলো তো হাংরি আন্দোলনের কবিতা। বিনয় তাই উপেক্ষিত ; ওনাকে অকাদেমি পুরস্কার দেয়া হয় জীবনের শেষ পর্বে। আরেকটা কারণ হল কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। আমার বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাস ধরে মামলা হয়েছিল; প্রদীপ চৌধুরীকে বিশ্বভারতী থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছিল, উৎপলকুমার বসুকে যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল; সুবিমল বসাক আর দেবী রায়কে সরকারি চাকরিতে কলকাতার বাইরে ট্রান্সফার করে দেয়া হয়েছিল। ক্লিন্টন বি সিলির জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থ ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট, বইটা পড়লে জানতে পারবে,  হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জীবনানন্দের যে জন্মদিন পালন করেছিল, তার বর্ণনা। উনি ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ তুলে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মে জীবনানন্দের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই খবর প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায়। সেদিন সন্ধ্যায় জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য  টেবিলে উঠে পড়েছিলেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকার অবনী ধর  নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন একটা গান, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে। উপস্থিত সাংবাদিকরা,  ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না।  তাঁরা গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা। ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে। ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য। অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন। যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান শট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের অন্যতম ছোটো গল্পকার। 

গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:

জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু।

জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,

জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু।

হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,

হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ

শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি।

উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ।

১৯২০ সালে, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে; কারোরই কঠিন মনে হবে না। উনি মোৎসার্টের এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন। গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল। এই রকমই ছিল তখনকার প্রতিক্রিয়া।

-মলয় রায়চৌধুরী

 

মেহেদী হাসান স্বাধীন: আন্দোলনটা ধপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল?

মলয় রায়চৌধুরী: বাংলাদেশে বসে সম্ভবত এরকম একটা ধারণা হয়ে থাকবে। মামলা হবার দরুন আমি বন্ধু-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলুম। কিন্তু হাংরি আন্দোলনের পত্রিকা তো নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। আমার মতন অরগ্যানাইজিং কেপেবিলিটি ছিল না বলে সেই সব পত্রিকা তেমন প্রচারিত হয়নি। প্রদীপ চৌধুরীর ‘ফুঃ’ পত্রিকা গত বছর ওনার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত নিয়মিত ‘ক্ষুধার্ত’, ‘ক্ষুধার্ত খবর’ প্রকাশ করেছেন। ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকার সব কয়টা সংখ্যা নিয়ে ভারতের সাহিত্য অকাদেমী থেকে সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। আমি ‘জেব্রা’ পত্রিকা প্রকাশ করতুম। সেগুলো নিয়ে গত বছর প্রকাশিত হয়েছে ‘অখণ্ড জেব্রা’, সমীরণ মোদকের সম্পাদনায়, ঢাকায় তক্ষশীলাতে পাওয়া যায়। সুবিমল বসাক সম্পাদিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, দেবী রায় সম্পাদিত ‘চিহ্ণ’, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত ‘উন্মার্গ’, অরুণেশ ঘোষ সম্পাদিত ‘জিরাফ’ পত্রিকার সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করেছেন সমীরণ মোদক, একত্রে সংকলিত করার জন্য, কিন্তু প্রকাশক পাচ্ছেন না। শিলিগুড়ি, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি থেকে আশির দশক জুড়ে অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, মনোজ রাউত, মলয় মজুমদার, সমীরণ ঘোষ, জীবতোষ দাশ প্রমুখ প্রকাশ করতেন ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’, ‘রোবোট’, আর ‘ধৃতরাষ্ট্র’ — কলকাতা থেকে দূরে বলে তেমন আলোচিত হয়নি। এই যে আমি এতোগুলো পত্রিকার নাম বললুম, আমি নিশ্চিত যে তোমার চোখে পড়েনি ; সম্ভবত এনাদের রচনাও পড়োনি। তাই মনে হতে পারে যে জ্বলেই নিভে গেল। তিন বছর আগে পেঙ্গুইন র‌্যানডাম হাউস থেকে হাংরি আন্দোলনকারীদের নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটা বই বেরিয়েছে, মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর লেখা; ইংরেজিতে আরেকটা বই বেরিয়েছে বৈদ্যনাথ মিশ্র এবং রাহুল দাশগুপ্তর সম্পাদনায়, ‘লিটারেচার অফ হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট – আইকনস অ্যাণ্ড ইমপ্যাক্ট’ নামে। গতবছর অলোক গোস্বামীর স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছে, ‘মেমারি লোকাল’ নামে। বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষকে নিয়ে প্রায় পাঁচশো পাতার দুটো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘মানুষের বাচ্চা’ পত্রিকা। ওদের দুজনের রচনাসমগ্র প্রকাশ করেছে গাঙচিল প্রকাশনী। সুবিমল বসাকের রচনাসমগ্র দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী। অরুণেশ ঘোষকে নিয়ে ছয়শো পৃষ্ঠার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে কবিতীর্থ পত্রিকা। শৈলেশ্বর ঘোষকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘কারুবাসনা’ পত্রিকা। এবাদুল হক আমাকে নিয়ে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার দুটো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। জানি না এই বই আর পত্রিকাগুলো বাংলাদেশে যায় না বলে তোমার মনে হয়ে থাকবে ধপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল।

তুমি যদি ইউটিউব দ্যাখো তাহলে সবচেয়ে পঠিত যে কবিতাটা পাবে তা হল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ আর আমার সাম্প্রতিক কবিতা ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’। আলোচনা অবিরাম হয়ে চলেছে। 

মেহেদী হাসান স্বাধীন: মলয় রায়চৌধুরীর চোখে হাংরি আন্দোলনের সময়কার সামাজিক বাস্তবতা এবং ইজম কনফ্লিক্টটা কেমন ছিল? 

মলয় রায়চৌধুরী: এটা দুচার লাইনে ব্যাখ্যা করা যায় না। তুমি আমার সাক্ষাৎকারসমগ্র ‘কথাবার্তা সংগ্রহ’ আর ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইদুটো পড়ে দেখতে পারো। প্রকাশক কলকাতার প্রতিভাস। ঢাকায় পাওয়া যায়। অবশ্য সাত-আটশো টাকা দাম বলে পাঠকের নাগালের বাইরে থেকে গেছে।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: আমরা শুনেছি একটা ইশতেহারের মাধ্যমেই সূচনা হয়েছিল হাংরি আন্দোলন। আসলে ইশতেহারে কী লেখা হয়েছিল যা সে সময়কার তারুণ্যকে নাড়া দিয়েছিল?

মলয় রায়চৌধুরী: হ্যাঁ, প্রথম দিকে হ্যাণ্ডবিলের মতন এক পাতার বুলেটিন বা ইশতেহার প্রকাশ করা হতো আর তা বিলিয়ে দেয়া হতো কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজি ম্যানিফেস্টো আর ১৯৬২ সালের শুরুতে বাংলা ম্যানিফেস্টো । পত্রিকা বের করলে পাঠকের কেনবার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হতো। এক পাতার বুলেটিন পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছে যেতো, প্রায় প্রতি সপ্তাহে । এইভাবে পৌঁছে যাওয়াটাই সাড়া ফেলার প্রধান কারণ । সংবাদপত্রে খবর, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি বেরোবার ফলে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল । যুগান্তর সংবাদপত্রে পরপর দু’দিন প্রধান সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল । আন্দোলন যেভাবে দ্রুত সাড়া ফেলেছিল, তরুণরা আপনা থেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন । পঁয়ত্রিশ-চল্লিশজন ছিলেন প্রথম কয়েক বছর । তারপর পুলিশের হস্তক্ষেপের কারণে অনেকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং আন্দোলন থেকে দূরত্ব গড়ে নিয়েছিলেন । আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইটায় তুমি প্রায় সব কয়টা ইশতেহারের কপি পাবে । তক্ষশীলা, বিদিত, পাঠক সমাবেশ, বাতিঘরকে বললে আনিয়ে দেবে ।

হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে কথার শেষ নেই। নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি। রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে। হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা। এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের হাংরিয়ালিস্ট প্রভাব পরবর্তিতে বাংলা সাহিত্যের লেখনীতে কী ধরনের বিশেষত্ব দিয়েছে?

মলয় রায়চৌধুরী: এই প্রশ্নের উত্তর অভিজিত পালের একটা প্রবন্ধে দেয়া আছে, ‘ভূবনডাঙা’ সাইটে। তোমার প্রশ্নের উত্তরের জন্য সেটা থেকে খানিকটা তুলে দিচ্ছি। অভিজিত লিখেছেন, বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের ন্যায় আর কোনও আন্দোলন তার পূর্বে হয় নাই। হাজার বছরের বাংলা ভাষায় এই একটিমাত্র আন্দোলন যা কেবল সাহিত্যের নয় সম্পূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে আঘাত ঘটাতে পেরেছিল, পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে তরুণ সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাহস যোগাতে পেরেছে। তাঁদের অবদান,

*** স্বীকৃতিচোদাদের জানতে ক্লিক করুন এখানে। ***

(১) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিলেন। কেবল তাই নয়; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন । তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা, ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন। পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায়। ফোলডারে স্কেচ আঁকতেন সুবিমল বসাক। ত্রিদিব মিত্র তাঁর ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিজে আঁকতেন। পরবর্তীকালে দুই বাংলাতে তাঁদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

(২) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করার কথা সাহিত্যিকরা চিন্তা করেন নাই। সুভাষ ঘোষ বলেছেন, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয়; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার। নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, ডিকশন, উদ্দেশ্য, শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকার সত্বেও বামপন্থী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে নিষ্কৃতি পান নাই। শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই। তা প্রথম করেন হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগন; উল্লেখ্য হলেন অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ। সুবিমল বসাকের পূর্বে ‘বাঙাল ভাষায়’ কেউ কবিতা ও উপন্যাস লেখেন নাই। হাংরি জেনারেশনের পরবর্তী দশকগুলিতে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রচনায় এই প্রভাব স্পষ্ট।

(৩) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে ল্যাবিরিনথাইন করে প্রয়োগ করা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস। মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলার সমাজে ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বামপন্থীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো। উল্লেখ্য তাঁর নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, গল্প ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ইত্যাদি। তিনি বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে লেখেন ‘আরেকবারে ক্ষুধিত পাষাণ’। বাঙাল ভাষায় লিখিত সুবিমল বসাকের কবিতাগুলিও উল্লেখ্য। পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও লেখকদের রচনায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট।

(৪) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের চতুর্থ অবদান হলো পত্রিকার নামকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হতো ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে তার বিপুল প্রভাব পড়েছে। পত্রিকার নামকরণে সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে।

(৫) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সর্বপ্রথম সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল। ‘কবিতা’, ‘ধ্রুপদি’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিম্নবর্গের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিনগুলির সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন। এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক,  জাহাজের খালাসি অবনী ধর, মালাকার পরিবারের নিত্য মালাকার ইত্যাদি। পরবর্তীকালে প্রচুর সাবঅলটার্ন কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল।

(৬) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো রচনায় যুক্তিবিপন্নতা, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা, আবেগের সমউপস্থিতি, কবিতার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেয়া, ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগতা বহুরৈখিকতা ইত্যাদি। তাঁদের আন্দোলনের পূর্বে টেক্সটে দেখা গেছে যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন যুক্তি ধাপে-ধাপে এগোতো, কবিতায় থাকতো আদি-মধ্য-অন্ত, রচনা হতো একরৈখিক, কেন্দ্রাভিগ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা।

(৭) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে লেখক-কবিগণ আশাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবে। ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন। হাংরি জেনারেশনের কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কবিতাগুলোতে বামপন্থীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। হাংরি জেনরেশনের পরের দশকের কবি ও লেখকগণের নিকট বামপন্থীদের দুইমুখো কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে মরিচঝাঁপি কাণ্ডের পর।

(৮) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে কবি-লেখকগণ মানকে সুনিশ্চিত করতে চাইতেন, পরিমেয়তা ও মিতকথনের কথা বলতেন, কবির নির্ধারিত মানে থাকত এবং স্কুল কলেজের ছাত্ররা তার বাইরে যেতে পারতেন না। হাংরি জেনারেশনের লেখকগণ অফুরন্ত অর্থময়তা নিয়ে এলেন, মানের ধারণার প্রসার ঘটালেন, পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিলেন রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার, প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করলেন। শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার সঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

(৯) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে ‘আমি’ থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক আমি থাকতো, লেখক-কবি ‘আমি’র নির্মাণ করতেন, তার পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড থাকতো, সীমার স্পষ্টিকরণ করতেন রচনাকার, আত্মপ্রসঙ্গ ছিল মূল প্রসঙ্গ, ‘আমি’র পেডিগ্রি পরিমাপ করতেন আলোচক। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ নিয়ে এলেন একক আমির অনুপস্থিতি, আমির বন্ধুত্ব, মানদণ্ড ভেঙে ফেললেন তাঁরা, সীমা আবছা করে দিলেন, সংকরায়ন ঘটালেন, লিমিন্যালিটি নিয়ে এলেন।

(১০) হাংরি  জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে শিরোনাম দিয়ে বিষয়কেন্দ্র চিহ্ণিত করা হতো। বিষয় থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক মালিকানা ছিল, লেখক বা কবি ছিলেন টাইটেল হোলডার। হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিগণ শিরোনামকে বললেন রুবরিক; শিরোনাম জরুরি নয়, রচনার বিষয়কেন্দ্র থাকে না, মালিকানা বিসর্জন দিলেন, ঘাসের মতো রাইজোম্যাটিক তাঁদের রচনা, বৃক্ষের মতন এককেন্দ্রী নয়। তাঁরা বললেন যে পাঠকই টাইটেল হোলডার।

(১১) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হতো ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একরৈখিক রীতিতে। তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে করতেন প্রগতি। এক রৈখিকতা এসেছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থের কাহিনির অনুকরণে; তাঁরা সময়কে মনে করতেন তা একটিমাত্র দিকে এগিয়ে চলেছে। আমাদের দেশে বহুকাল যাবত সেকারণে ইতিহাস রচিত হয়েছে কেবল দিল্লির সিংহাসন বদলের। সারা ভারত জুড়ে যে বিভিন্ন রাজ্য ছিল তাদের ইতিহাস অবহেলিত ছিল। বহুরৈখিকতারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘মহাভারত’। হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকগণ একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার সূত্রপাত ঘটালেন। যেমন সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ উপন্যাস, মলয় রায়চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্থ ‘আমার চাবি, ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’ ইত্যাদি। তাঁরা গ্রহণ করলেন প্লুরালিজম, বহুস্বরের আশ্রয়, দিকবিদিক গতিময়তা, হাংরি জেনারেশনের দেখাদেখি আটের দশক থেকে কবি ও লেখকরা বহুরৈখিক রচনা লিখতে আরম্ভ করলেন।

(১২) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে মনে করা হতো কবি একজন বিশেষজ্ঞ। হাংরি জেনারেশনের কবিরা বললেন কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য। পরবর্তী প্রজন্মে বিশেষজ্ঞ কবিদের সময় সমাপ্ত করে দিয়েছেন নতুন কবির দল এবং নবনব লিটল ম্যাগাজিন।

(১৩) ঔপনিবেশিক প্রভাবে বহু কবি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতেন। ইউরোপীয় লেখকরা যেমন নিজেদের ‘নেটিভদের’ তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ একজনকে তুলে ধরা, নায়ক-কবি, সরকারি কবির শ্রেষ্ঠত্ব, হিরো-কবি, এক সময়ে একজন বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ড বিশিষ্ট কবি আইকন কবি ইত্যাদির প্রচলন ছিল। হাংরি জেনারেশন সেই ধারণাকে ভেঙে ফেলতে পেরেছে তাদের উত্তরঔপনিবেশিক মূল্যবোধ প্রয়োগ করে। তারা বিবেচন প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দিতে পেরেছে, কবির পরিবর্তে একাধিক লেখককের সংকলনকে গুরুত্ব দিতে পেরেছে, ব্যক্তি কবির পরিবর্তে পাঠকৃতিকে বিচার্য করে তুলতে পেরেছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলেছে। সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কৌমের কথা বলেছে। তাঁদের পরবর্তী কবি-লেখকরা হাংরি জেনারেশনের এই মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন।

(১৪) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল। রচনা ছিল কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন। হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন, কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে, কথার শেষ নেই। নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি। রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে। হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা। এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(১৫) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ‘বাদ’ দেবার প্রবণতা; সম্পাদক বা বিশেষ গোষ্ঠী নির্ণয় নিতেন ‘কাকে কাকে বাদ দেয়া হবে’। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছিল “এলিমিনেশন”। বাদ দেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে তাঁরা নিজেদের আয়ত্বে রাখতেন। হাংরি জেনারেশনের সম্পাদকরা ও সংকলকরা জোট বাঁধার কথা বললেন। যোগসূত্র খোঁজার কথা বললেন। শব্দজোট, বাক্যজোট, অর্থজোটের কথা বললেন। এমনকি উগ্র মতামতকেও পরিসর দিলেন। তাঁদের এই চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালের সম্পাদক ও সংকলকদের অবদানে স্পষ্ট। যেমন, অলোক বিশ্বাস আটের দশকের সংকলনে ও আলোচনায় সবাইকে একত্রিত করেছেন। বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাড়া সমস্ত লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে এই গুণ উজ্বল।

(১৬) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত একটিমাত্র মতাদর্শকে, ইজমকে, তন্ত্রকে, গুরুত্ব দেয়া হতো। কবি-লেখক গোষ্ঠীর ছিল ‘হাইকমাণ্ড’, ‘হেডকোয়ার্টার’, ‘পলিটব্যুরো’ ধরণের মৌরসি পাট্টা। হাংরি জেনারেশন একটি আন্দোলন হওয়া সত্বেও খুলে দিল বহু মতাদর্শের পরিসর, টুকরো করে ফেলতে পারলো যাবতীয় ‘ইজম’, বলল প্রতিনিয়ত রদবদলের কথা, ক্রমাগত পরিবর্তনের কথা। ভঙ্গুরতার কথা। তলা থেকে ওপরে উঠে আসার কথা। হাংরি জেনারেশনের পরে সম্পূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন জগতে দেখা গেছে এই বৈশিষ্ট্য এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব।

(১৭) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত দেখা গেছে ‘নিটোল কবিতা’ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ এলিটিস্ট কবিতা রচনার ধারা। তাঁরা বলতেন রচনাকারের শক্তিমত্তার পরিচয়ের কথা। গুরুগম্ভীর কবিতার কথা। নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক মডেলের কথা। যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি। হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ নিয়ে এলেন এলো-মেলো কবিতা, বহুরঙা, বহুস্বর, অপরিমেয় নাগালের বাইরের কবিতা। তাঁদের পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মাঝে এর প্রভাব দেখা গেল। এখন কেউই আর ঔপনিবেশিক বাঁধনকে মান্যতা দেন না। উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় অলোক বিশ্বাস, দেবযানী বসু, ধীমান চক্রবর্তী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা।

(১৮) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল স্থিতাবস্থার কদর এবং পরিবর্তন ছিল শ্লথ। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ পরিবর্তনের তল্লাশি আরম্ভ করলেন, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপকে স্বীকৃতি দিলেন। পরবর্তী দশকগুলিতে এই ভাঙচুরের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন কমল চক্রবর্তী, সুবিমল মিশ্র, শাশ্বত সিকদার, সুব্রত সেন, দেবজ্যোতি রায় ও নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে; তাঁরা ভাষা, চরিত্র, ডিকশন, সমাজকাঠামোকে হাংরি জেনারেশনের প্রভাবে গুরুত্ব দিতে পারলেন।

(১৯) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে নাক-উঁচু সংস্কৃতির রমরমা ছিল, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা হতো, শ্লীল ও অশ্লীলের ভেদাভেদ করা হতো, ব্যবধান গড়ে ভেদের শনাক্তকরণ করা হতো। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন। বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের। অভেদের সন্ধান করলেন। একলেকটিকতার গুরুত্বের কথা বললেন। বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের বিলোপ ঘটালেন। উল্লেখ্য যে বুদ্ধদেব বসু মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর দ্বারে দেখামাত্র দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালের লিটল ম্যাগাজিনে আমরা তাঁদের এই অবদানের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষ্য করি।

(২০) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল ইউরোপ থেকে আনা বাইনারি বৈপরীত্য যা ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা ধারণ করেছিল তাদের ধর্মের ঈশ্বর-শয়তান বাইনারি বৈপরীত্য থেকে। ফলত, দেখা গেছে ‘বড় সমালোচক’ ফরমান জারি করছেন কাকে কবিতা বলা হবে এবং কাকে কবিতা বলা হবে না; কাকে ‘ভালো’ রচনা বলে হবে এবং কাকে ভালো রচনা বলা হবে না; কোন কবিতা বা গল্প-উপন্যাস  উতরে গেছে এবং কোনগুলো যায়নি ইত্যাদি। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা এই বাইনারি বৈপরীত্য ভেঙে ফেললেন। তাঁরা যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা রচনার কথা বললেন ও লিখলেন, যেমন সুভাষ ঘোষের গদ্য গ্রন্থগুলি। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন বহুপ্রকার প্রবণতার ওপর, রচনাকারের বেপরোয়া হবার কথা বললেন, যেমন মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা। যেমন মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা ও ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাস। যেমন সুবিমল বসাকের বাঙাল ভাষার কবিতা যা এখন বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসুও অনুকরণ করছেন। হাংরি জেনারেশনের পরের দশকগুলিতে তাঁদের এই অবদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে।

(২১) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল আধিপত্যের প্রতিষ্ঠার সাহিত্যকর্ম। উপন্যাসগুলিতে একটিমাত্র নায়ক থাকত। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ আধিপত্যের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন তাঁদের রচনাগুলিতে। বামপন্থী সরকার থাকলেও তাঁরা ভীত হলেন না। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সেকারণে ছিল খণ্ডবাদ বা রিডাকশানিজমের গুরুত্ব। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন কমপ্লেকসিটিকে, জটিলতাকে, অনবচ্ছিন্নতার দিকে যাওয়াকে। যা আমরা পাই বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ প্রমুখের গল্প-উপন্যাসে। পরবর্তী দশকগুলিতে দুই বাংলাতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

(২২) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভকে। হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন মাইক্রো ন্যারেটিভকে, যেমন সুবিমল বসাকের ‘দুরুক্ষী গলি’ নামক উপন্যাসের স্বর্ণকার পরিবার, অথবা অবনী ধরের খালাসি জীবন অথবা তৎপরবতী কঠিন জীবনযাপনের ঘটনানির্ভর কাহিনি। পরবর্তী দশকগুলিতে দেখা যায় মাইক্রোন্যারেটিভের গুরুত্ব, যেমন গ্রুপ থিয়েটারগুলির নাটকগুলিতে।

(২৩) হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ নিয়ে এলেন যুক্তির ভাঙন বা লজিকাল ক্র্যাক, বিশেষত দেবী রায়ের প্রতিটি কবিতায় তার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। পরের দশকের লেখক ও কবিদের রচনায় লজিকাল ক্র্যাক অর্থাৎ যুক্তির ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। যেমন সাম্প্রতিক কালে অগ্নি রায়,  রত্নদীপা দে ঘোষ, বিদিশা সরকার, অপূর্ব সাহা, সীমা ঘোষ দে, সোনালী চক্রবর্তী, আসমা অধরা, সেলিম মণ্ডল, জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া জেরিন প্রমুখ।

(২৪) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে রচনায়, বিশেষত কবিতায়, শিরোনামের গুরুত্ব ছিল; শিরোনামের দ্বারা কবিতার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করার প্রথা ছিল। সাধারণত বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত এবং সেই বিষয়ানুযায়ী কবি কবিতা লিখতেন। শিরোনামের সঙ্গে রচনাটির ভাবগত বা দার্শনিক সম্পর্ক থাকতো। ফলত তাঁরা মৌলিকতার হামবড়াই করতেন, প্রতিভার কথা বলতেন, মাস্টারপিসের কথা বলতেন। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ শিরোনামকে সেই গুরুত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন। শিরোনাম আর টাইটেল হোলডার রইলো না। শিরোনাম হয়ে গেল ‘রুবরিক’। তাঁরা বহু কবিতা শিরোনাম র্বজন করে সিরিজ লিখেছেন। পরবর্তী দশকের কবিরা হাংরি জেনারেশনের এই কাব্যদৃষ্টির সঙ্গে একমত হয়ে কবিতার শিরোনামকে গুরুত্বহীন করে দিলেন; সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন যার একটিতেও শিরোনাম নেই।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: ফ্রয়েডীয় মনোবীক্ষণ কি কোনো ভাবেই হাংরি মুভমেন্টের গভীরতাকে সরলীকরল করতে পারে?

মলয় রায়চৌধুরী: ফ্রয়েড সম্পর্কে জীবনানন্দের বক্তব্য পড়েছ? মাল্যবান উপন্যাসে মাল্যবান বলছে, “স্বপ্নের কী জানেন ফ্রয়েড? ভিয়েনা শহরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্নায়ুরোগীদের স্বপ্ন নিয়ে কোনো স্বপ্নতত্ত্ব বানানো যায় না। চড়কের মাঠে কোনোদিন তো আর যাবেন না ফ্রয়েড সাহেব, স্বপ্নের আর কী বুঝবেন।” এই প্রসঙ্গে গৌতম মিত্র বলেছেন, “কী ভয়ঙ্কর রকমের আধুনিক একজন চিন্তক জীবনানন্দ দাশ ভেবে অবাক হই। ঠিক এখানেই ফ্রয়েডেরই শিষ্য কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংও ফ্রয়েডের থেকে আলাদা হয়ে যান। ইয়ুংও মনে করেন, শুধু ব্যক্তি নির্জ্ঞান নয়, স্বপ্নের ক্ষেত্রে যৌথ নির্জ্ঞানেরও একটি ইতিবাচক ভূমিকা আছে। আর সেজন্যই কি জীবনানন্দ চড়কের ইঙ্গিত করেন? ফলিত বিজ্ঞানের ফ্রয়েড থেকে তত্ত্ব বিজ্ঞানের ইয়ুং বেশি কাছের।” হাংরি আন্দোলন একটা যৌথ মুভমেন্ট, তাকে ফ্রয়েডের তত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা ভুল হবে; তাছাড়া ফ্রয়েড বিশ্লেষণ করেছেন পাশ্চাত্য দৃষ্টিতে যার সঙ্গে প্রাচ্যের কৌম-মননের বিস্তর ফারাক।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: আমরা দেখেছি সে সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদোর দালি পরাবাস্তব চিত্রকাণ্ড নিয়ে মেতে আছেন। অথচ তার চিত্রগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দাদাইজমের শিকড় পাওয়া যায়। ইজম কেন্দ্রিক সুন্দর নির্মাণ কিংবা আঁকবার চেষ্টাটা কি হাংরি আন্দোলন ভেঙে দিয়েছিলো? হতে পারে সেটি কবিতায়, গদ্যে কিংবা আঁকা ছবিতে। বাস্তবতা তো কবিতার মতো সুন্দর না, আঁকা ছবির মতো কালার কনট্রাস্টে ভরা না! আপনার অভিমত কী?

মলয় রায়চৌধুরী: পরাবাস্তববাদের নেতা আঁদ্রে ব্রেতঁ দালির পেইনটিঙগুলো পরাবাস্তব প্রদর্শনী থেকে বের করে ফেলে দিয়েছিলেন। তা জানো? অথচ দালি নিজেকে বলেছেন পরাবাস্তববাদী, ডাডাবাদী নয়। দালির পেইনটিঙ সুন্দর নয় বলতে চাইছ? ভাউল ধারণা। তাহলে পিকাসোকে কী বলবে। আমি ইউরোপে গিয়ে ওনাদের পেইনটিঙ দেখেছি আর হর্ষ অনুভব করেছি। হাংরি আন্দোলনে কয়েকজন পেইনটার ছিলেন, যাদের মধ্যে অনিল করঞ্জাই অগ্রগণ্য। ওনাকে নিয়ে ইংরেজিতে একটা বই বেরিয়েছে ২০১৮ সালে, জুলিয়েট রেনল্ডস-এর লেখা, ‘রোডস অ্যাক্রস দ্য আর্থ’ নামে। আমি নিশ্চিত যে এই বইটাও বাংলাদেশে যায়নি। বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি যদি হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত বইগুলো ওনাদের লাইব্রেরিতে রাখেন তাহলে ওখানকার পাঠকদের সুবিধা হবে। তোমরা অনুরোধ করে দেখতে পারো।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি মুভমেন্ট নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার যখন সরব তখন আমেরিকা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয় রায়চৌধুরীকে লিখে পাঠালেন, “কলকাতা শহরটা আমার, ফির গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব। দু’একজন বন্ধুবান্ধব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি। এখনও সে ক্ষমতা রাখি। লেখার বদলে হাঙ্গামা ও আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি। যতো খুশি আন্দোলন করো, বাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না।”  সুনীলের এই বক্তব্য জানবার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল? কিংবা আপনার সহযোদ্ধা কবি-বন্ধুদের কী বলেছিলেন?

মলয় রায়চৌধুরী: আমার চিঠির জবাবেই সুনীল ওই চিঠিটা আমাকে লিখেছিলেন। উনি ভেবেছিলেন ওনার অবর্তমানে আমরা বাংলা সংস্কৃতির দখল নিয়ে নিচ্ছি। ওই সময়েই উনি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসুকে লিখেছিলেন হাংরি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যেতে। ওনার মনে হয়েছিল ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার বিরুদ্ধে খাড়া করা হয়েছে হাংরি আন্দোলনকে। কিন্তু কৃত্তিবাস তো ছিল একটা পত্রিকা, ফিরে এসে আবার শুরু করে চালিয়েছেন মৃত্যু পর্যন্ত। আমরা খুব হাসাহাসি করেছিলুম ওনার চিঠি পড়ে। শক্তিকে নেতা করা হয়েছিল বলে সুনীল চটে গিয়েছিলেন। আমেরিকা যাবার আগে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে উনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন. “আমি কী শক্তির থুতু চাটবো?”  ফিরে এসে ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকায় বাসব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মলয় আমার আমেরিকাবাসের সুযোগটা নিয়েছিল’। যে-কোনো আন্দোলনের জন্ম হয় কোনো না কোনো আধিপত্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে। তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা। হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁকে বাদ দেবার জন্যেই এই আন্দোলন। তাঁর ধারণা ভুল ছিল। যে-কোনো কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার। বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে (অন্তত যে কয়টির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কতৃক ১৯৬৩’র শেষ দিক থেকে ১৯৬৪ এর প্রথম দিকে প্রকাশিত। ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম, কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুও নিজের খরচে বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না। এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে-থাকা সত্বাধিকার-বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক। সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে পারসোনাল পজেশান  ছিল, কিন্তু প্রায়ভেট প্রপার্টি  ছিল না। ইউরোপীয়রা বাঙালিকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, এবং তা করার পরই ব্যক্তিমানুষ প্রকৃতির মালিকানা দাবি করার যোগ্য মনে করা আরম্ভ করেন নিজেকে। হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুবিমল বসাক, হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে, একটি সাইক্লোস্টাইল-করা ত্রিভাষিক (বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি) বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন, তদানীন্তন সাহিত্যিক সন্দ্যফের প্রেক্ষিতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভ যে কাজ উপস্থাপন করতে চাইছে তা স্পষ্ট করার জন্যে। তাতে দেয়া তালিকাটি থেকে আন্দোলনের অভিমুখের কিছুটা হদিশ মিলবে:

প্রথাগত সাহিত্য সন্দর্ভ

হাংরি প্রতিসন্দর্ভ

প্রাতিষ্ঠানিক

শাসক সম্প্রদায় (টিরানি)

ভেতরের লোক (অন্দরুনি)

এলিটেতর সংস্কৃতি (ঢাকোসলা)

তৃপ্ত

আসঞ্জনশীল

লোকদেখানো (দিখাওয়া)

জ্ঞাত যৌনতা (পরিচিত )

সিশিয়ালিস্ট

প্রেমিক (দুলারা)

একসট্যাসি

নিশ্চল (আনমুভড)

ঘৃণার কামোফ্লাজ

আর্ট (ফিল্ম)

শিল্প

রবীন্দ্রসঙ্গীত (সুগমসঙ্গীত)

স্বপ্ন (ড্রিম)

শিষ্ট ভাষা (টিউটর্ড)

রিদিমড (দায়মুক্ত)

ফ্রেমের মধ্যে

কনফরমিস্ট (অনুগত)

উদাসীন (ইনডিফারেন্ট)

মেইনস্ট্রিম (মূলস্রোত)

কৌতুহল

আনন্দ (এন্ডোক্রিন)

পরিণতি অবশ্যম্ভাবী

সমাপ্তি প্রতিমা (আনুষ্ঠানিক)

ক্ষমতাকেন্দ্রিক (সিংহাসন)

মনোহরণকারী (এনটারটেইনার)

আত্মপক্ষ সমর্থন

আমি কেমন আছি (একপেশে)

প্রতিসম

ছন্দের একাউন্ট্যান্ট

কবিতা নিখুঁত করতে কবিতা রিভাইজ

কল্পনার খেলা

প্রতিষ্ঠানবিরোধী

শাসকবিরোধী (প্রটেস্টার)

বহিরাগত (হামলাবোল)

জনসংস্কৃতি

অতৃপ্ত

খাপছাড়া (ব্রিটল)

ছামড়া ছাড়ানো ( বোন)

অজ্ঞাত যৌনতা (অপরিচিত)

সোশিয়েবল

শোককারী (মোর্নার)

অ্যাগনি

তোলপাড় (টার্বুলেন্ট)

খাঁটি ঘৃণা

জনগণ (সিনেমা)

জীবনসমগ্র

যে কোনো গান

দুঃস্বপ্ন (নাইটমেয়ার)

গণভাষা (গাট ল্যাংগুয়েজ)

আনরিডিমড (দায়বদ্ধ)

ফ্রেমহীন (কনটেসটেটরি)

ডিসিডেন্ট (ভিন্নমতাবলম্বী)

এথিকসসংক্রান্ত

ওয়াটারশেড (জলবিভাজিকা)

উদ্বেগ

উৎকন্ঠা (অ্যাড্রেনালিন)

উন্মেষের শেষ নাই

সতত সৃজ্যমান (উৎসব)

ক্ষমতাবিরোধী (সিংহাসনত্যাগী)

চিন্তাপ্রদানকারী (থটপ্রোভোকার)

আত্মআক্রমণ

সবাই কেমন আছে

অসম্বদ্ধ (স্ক্যাটার্ড)

বেহিসাবি ছন্দ খরচ

জীবনকে প্রতিনিয়ত রিভাইজ

কল্পনার কাজ

মেহেদী হাসান স্বাধীন: ’৬৫ সালে নিজের দাদার সাথে আপনিসহ ৬ জন কবি গ্রেপ্তার হন। বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের এই বিরল ঘটনার পর হাংরি মুভমেন্ট কোন পথে ধাবিত হয়েছিল?

মলয় রায়চৌধুরী: সবাই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। মামলাটা কেবল আমার বিরুদ্ধে হয়েছিল, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার বিরুদ্ধে, পঁয়ত্রিশ মাস। কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। চাকরি থেকে সাসপেণ্ড ছিলুম বলে টাকাকড়িরও টানাটানি ছিল, এক বেলা খেয়ে চালিয়ে দিতুম। কিন্তু আন্দোলনের পত্রপত্রিকা নিয়মিত বেরোতো তা তো এক্ষুনি উল্লেখ করেছি। এক পাতার বুলেটিন ছাপানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেননা প্রেসগুলো হাংরি শুনলেই ভয় পেতো। বই-পত্রিকা ছাপাতুম বহরমপুরের একটা প্রেসে। মামলার পর হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে লিটল ম্যাগাজিনের কবিতা ও গদ্যের সৃজনশীলতায়।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: আন্দোলন সংশ্লিষ্ট তরুণ কবিদের হাংরি জেনারশন বলে সম্বোধন করা হলো। তো এই জেনারেশন হাংরি মুভমেন্টের মাধ্যমে আসলে কী অর্জন কিংবা কী তুলে ধরতে চাইছিলো?

মলয় রায়চৌধুরী: ওই তো, অভিজিত পালের লেখাটায় সবই তো বলা হয়ে গেছে।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: কোনো কারণে কি এই আন্দোলন জনবিচ্ছন্ন ছিল? থাকলে সেটি কী? কিংবা এই আন্দোলনকে দালাল শ্রেণির মানুষ সাধারণের বিপরীতে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছিল?

মলয় রায়চৌধুরী: জনসাধারণের সঙ্গে সাহিত্য আন্দোলনের যোগাযোগ কোনো দেশেই হয়নি কখনও। এক পাতার বুলেটিনে যা করা গিয়েছিল তাই যথেষ্ট। আমাদের বইপত্র কোনোকালেই কমার্শিয়াল ছিল না। বড়ো প্রকাশকরা আগ্রহ দেখায়নি, আজও দেখায় না । আমার বিরোধী লেখক-কবিতে এখনও কফিহাউস ছেয়ে আছে। তাদের যদি দালাল বলো তো আমার আপত্তি নেই।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। হাংরি আন্দোলন সূত্রপাত হওয়ার আগেকার মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে জানতে চাই। কেমন ছিল ২১ বছরের তরুণ মলয় রায়চৌধুরী?

মলয় রায়চৌধুরী: আবার একই কথা বলতে হচ্ছে। আমার স্মৃতিকথাগুলো পোঁছিচ্ছে না বাংলাদেশে। তুমি যোগাড় করতে পারলে আমার ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা; ছোটোলোকের যুববেলা’ আর ছোটোলোকের শেষবেলা পোড়ো। যদি চাও তো তোমার সাইটে ‘আমার জীবন’ প্রকাশ করতে পারো, তাতে সব পাবে। বলো তো পাঠিয়ে দিই।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: আর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বার পর একজন মলয় রায়চৌধুরীকে আপনি নিজে কীভাবে খণ্ডন করবেন?

মলয় রায়চৌধুরী: খণ্ডন করতে যাবো কেন? সব আন্দোলনই তার সময়ের প্রডাক্ট। এখন কেউ কি মহাকাব্য বা মঙ্গলকাব্য লেখে? লেখে না ,কারণ ওগুলো ছিল তাদের সময়ের প্রডাক্ট। মলয় রায়চৌধুরীর লেখালিখি সম্পর্কে জানতে হলে তুমি গোটাকতক বই অন্তত পড়ো। তাহলে নিজেই টের পাবে।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি মুভমেন্ট পরবর্তি সময়ে হাংরি জেনারেশনের অবস্থানটা সামাজিকভাবে কেমন ছিল? মানুষ কীভাবে গ্রহণ করেছিল তাদের?

মলয় রায়চৌধুরী: বললুম তো, জনসাধারণের স্তরে সৃজনশীল সাহিত্য সেইভাবে পৌঁছোয় না যেমন যায় কমার্শিয়াল লেখা বা পাল্প ফিকশান। এই যে ষাট বছর পর তুমি হাংরি আন্দোলনে আগ্রহী, এটাই তো প্রমাণ যে আন্দোলন একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্হান গড়ে ফেলতে পেরেছে।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরি আন্দোলনে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বটা কেমন ছিল? আন্দোলনটা চিমসে যাওয়ার পর শক্তির সমাজ এবং আত্ম পরম্পরাটা কেমন দেখেছেন?

হাংরিয়ালিস্ট কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়

মলয় রায়চৌধুরী: শক্তি ওই এক বছরই ছিলেন। শক্তি ছেড়ে যান কারণ উনি দাদার শ্যালিকা শীলার সঙ্গে প্রেম করতেন। দাদার চাইবাসার বাড়িতে তিন বছর ছিলেন, প্রেম করবার সময়ে। শক্তির কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্যর’ কবিতাগুলো শীলাকে নিয়ে লেখা। দাদার শশুরবাড়ি চাইবাসায়। দাদার শশুর একজন মাতাল আর বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাননি। শক্তি ভেবেছিল আমি আর দাদা বিরোধিতা করেছি বলে শীলার সঙ্গে ওনার বিয়েটা ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছে। ব্যাস চটে গেলেন আমার আর দাদার ওপর। বদলা নিলেন কাঠগড়ায় সরকারি সাক্ষীর রূপে দাঁড়িয়ে।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: ‘The Decline of the West’ বইটি হাংরি মুভমেন্টের সাথে কীভাবে জড়িয়ে গেল? একইসাথে জানতে চাইছি হাংরির দার্শনিক অবয়বটা আসলে কী?

“History exists only as the history of something. IT we are referring to the history of the great Cultures, then nation is the thing moved. State, status, means condition, and we obtain our impression of the State when, as a Being in moved Form flows past us, we fix in our eyes the Form as such, as something extended and timelessly standing fast, and entirely ignore direction and Destiny.”

মলয় রায়চৌধুরী: অসওয়াল্ড স্পেঙলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট বইটা পড়ার পরই আমার ধারণা হয় সমাজ কী ভাবে কাজ করছে ভারতে, বিশেষভাবে পশ্চিমবাংলায়। সেই সময়ে আমি ইতিহাসের দর্শন নামে একটা ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখছিলুম বিংশ শতাব্দী পত্রিকায়। অসওয়াল্ড স্পেঙলার বলেছেন, একটি সংস্কৃতি কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা লিনিয়র নয়, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। তা হল জৈবিক প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশ কোন দিকে কার বাঁকবদল ঘটবে, তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করতে থাকে; তার নিত্য নতুন স্ফূরণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয়, যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই ‘আত্মসাৎ’ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। আমার মনে হয়েছিল, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ঙ্কর অবসাদের মুখে পড়েছে। কলকাতা থেকে পাণিহাটি যাবার সময়ে (দাদা সমীর পাণিহাটিতে মামার বাড়িতে থেকে কলকাতার সিটি কলেজে যাতায়াত করতেন) আমি আর দাদা উদ্বাস্তুদের অসহায় জীবন প্রত্যক্ষ করতুম প্রতিদিন, কলকাতার পথে দেখতুম বুভুক্ষুদের প্রতিবাদ মিছিল। ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিবাদ প্রকাশ করার জন্য আমাদের দুজনের মনে হয়েছিল হাংরি আন্দোলন জরুরি। আমার মনে হয়, তাঁরা না করলেও অন্যেরা এই ধরণের আন্দোলন করত, প্রতিষ্ঠানকে নাস্তানাবুদ করত। আমি ওই সময়টাকে ধরার চেষ্টা করেছি ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে; বইটা ঢাকায় পাওয়া যায়।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: হাংরির ঢেউ বাংলাদেশেও এসেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে আশির দশকের কবিদের লেখনীতে কদাচিৎ আঁচ পাওয়া যায়। কারণ তখন বাংলাদেশের যুব সমাজ একটা বিশৃঙ্খল আর স্বৈরাচারী শৃঙ্ক্ষলে আটকা পড়েছিল। ফলে সে সময় কবিরা শিল্পীরা একাট্টা হয়ে লড়তে থাকে। আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন, বাংলাদেশের আশির দশকের সাহিত্য?

মলয় রায়চৌধুরী: বাংলাদেশের সাহিত্যে আঁচের ব্যাপারটা জানি না। তোমার মুখেই প্রথম শুনছি।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: এটা বলার অবশেষ থাকে না যে, হাংরি জেনারেশন দেশ ছাড়িয়ে মহাদেশে তার ঢেউ খেলিয়ে দিয়েছে। হাংরিয়ালিস্টদের রুখতে রাষ্ট্রযন্ত্র তার কূটকৌশলের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তো, হাংরিকে আপনি কতোটা সমাজবান্ধব আন্দোলন বলে মূল্যায়ন করবেন?

মলয় রায়চৌধুরী: ওসব মূল্যায়ন তোমরা করবে, সমাজ-বিশ্লেষকরা করবেন। ওটা আমার কাজ নয়।

মেহেদী হাসান স্বাধীন: সবশেষ জানতে চাই, হাংরিয়ালিস্ট যদি একটি মতবাদ হয়ে উঠে তবে বাংলাসাহিত্যে এর প্রভাব এবং বর্তমান সাহিত্যে এর মেলবন্ধনটা কী? 

মলয় রায়চৌধুরী: যে-কোনো আন্দোলনের জন্ম হয় কোনো না কোনো আধিপত্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে। তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা। হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁকে বাদ দেবার জন্যেই এই আন্দোলন। তাঁর ধারণা ভুল ছিল। যে-কোনো কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার। বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে (অন্তত যে কয়টির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কতৃক ১৯৬৩-র শেষ দিক থেকে ১৯৬৪ এর প্রথম দিকে প্রকাশিত। ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম, কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুও নিজের খরচে বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না। এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে-থাকা সত্বাধিকার-বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক।

সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে পারসোনাল পজেশান  ছিল, কিন্তু প্রাইভেট প্রপার্টি  ছিল না।

ইউরোপীয়রা বাঙালিকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, এবং তা করার পরই ব্যক্তিমানুষ প্রকৃতির মালিকানা দাবি করার যোগ্য মনে করা আরম্ভ করেন নিজেকে।

হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, গভর্নিং কাউন্সিল বা সম্পাদকের দপতর ধরণের ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল না, যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকার ক্ষমতাকেন্দ্র সেই বাড়িতে চলে যেত। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায়, যে কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপালি, অসমীয়া মরাঠী ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল। হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা আসলে ভূমিকম্পের মতো। সেই ভূমিকম্প প্রচলিতের ভিতে আঘাত করেছিল, ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো। যার আফটার এফেক্টে একপ্রকার উপকার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ সমালোচনায় শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা।’’ এইধরণের সাহিত্য বোধের প্রয়োজন এখনও ফুরায়নি।

মুক্তচিন্তা-বাকস্বাধীনতা এসব শুধু টার্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মত প্রকাশের অধিকার আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। এখনকার এই প্রচলিত সাহিত্যচর্চা সমাজকে কতোটা পরিবর্তন করতে পারছে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। বস্তুত সেই থ মেরে থাকা অবস্থা সাহিত্যে আজো কাটেনি, সাহিত্য এখনও কর্পোরেট দাসত্বে আটকে আছে। বিভিন্ন বাধ্যবাধকতায় লেখকের স্বাধীনতা এখন খাঁচায় বন্দী। এখনও মাঝে-মধ্যে কিশোর-তরুণরা এখান-সেখান থেকে নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে গর্বিত হন। ফেসবুকে হাংরি জেনারেশন নামে তরুণদের কয়েকটা গোষ্ঠী নজরে পড়েছে। 

3 thoughts on “হাংরি, খোলস ভাঙার প্রচণ্ড ইচ্ছা!”

  1. পার্থ মুখোপাধ্যায়

    মুদ্রিত সাক্ষাৎকারটি কিভাবে পাব ?

    1. এ ব্যাপারে বোকাবিডি দুঃখ প্রকাশ করছে। বোকা ভার্চুয়াল প্রকাশনের বাইরে মুদ্রণ করে না।
      ধন্যবাদ।

  2. Pingback: আশিক রেজা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top