রেহানা মরিয়ম নূর এবং এক এলিয়েন দর্শক

বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন

লেখাটা শুরু করবার আগেই বলে নিচ্ছি- আমার মুখ দিয়ে ভালো কথা কালেভদ্রে হয়তো বের হয়। অর্থাৎ খারাপ কথাটাই আমার সহজাত রীতি! তাই পুরুষরা যেমন বাঁধনকে নিতে পারবে না (একটা হেডলাইনে বাঁধনের এমন একটা কথা পড়েছিলাম) তেমনি শিল্প-সাহিত্য চলচ্চিত্রের সাধারণ মাস্টারপিসরাও আমাকে নিতে পারবে না! (😁) তাই গালাগালি কইরা হুদাই প্যারা নিবেন না।

বই আর চলচ্চিত্রে বুদ হয়ে থাকাটা আমার জন্যে দুনিয়াতে সব থেকে সোজা কাজ। বই আর চলচ্চিত্রের মধ্যে আমি সব সময় একটা পার্থক্য করি। একটা মস্তিষ্কের অনুরণন বাড়িয়ে দেয় আরেকটা থামিয়ে দেয়। দুটো ব্যাপারই আমার কাছে দারুণ লাগে। এ দুটোর কোনোটা না ঘটলে আমার হাত-পা নিসপিস করে। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। রেহানা মরিয়ম নূর দেখে আমার মস্তিষ্কের অনুরণন থেমে গেছে। শরীরমন ঠিকঠাক কাজ করছিল। অর্থাৎ রেহানা মরিয়ম নূর আমার শকুন চোখ থেকে উৎরে গেছে।

কান ফাটানো এই চলচ্চিত্র দেখবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তাই বেশ আগে থেকেই একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। ১২ নভেম্বর ব্যাপারটি ঘটলো। দেশের বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহে প্রজেকশন শুরু হলো। টিকিট যাতে পাই তই অনেক আগেই বসুন্ধরার স্টার সিনেপ্লেক্সের কাউন্টারে গিয়ে টিকিট নিয়েছি। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি দর্শক সমাগমটা কেমন ঘটলো। শুক্রবারের দুপুরের শো- দর্শক উপচে পড়বে এমনটা আশা করছি না। কিন্তু একটা লেভেল পর্যন্ততো আশা করতেই পারি, কিন্তু হলে গিয়ে আমার সে আশায় গুড়ে বালি!

সিনেমা শুরু হয়ে গেল। একটা ধাক্কা খেলাম! পুরুষালি এই মেয়েটা কে? এতো জেদ! এতো রাগ! স্পট টু স্পট শট বাই শট এই জেদ আমাকে গল্পে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ফ্রেম ট্রেন্ড নিউ ফর্মুলা কম্পোজিশন কাটিং, বুঝতে পারছি দারুণ চমৎকারিত্বে ভরা। কিন্তু চুদির ভাই সিনেপ্লেক্সের প্রজেকশন এতো বাজে- স্ক্রিন আন্ডার এক্সপোজড, এসির শব্দ, একটু পর পর একজিট ডোর খোলা মোটের উপর ফিল্ম দেখতে গিয়া দর্শক খেদায়া দেওনের ব্যবস্থা! আর এই কারণে দারুণ ব্যাপারগুলো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মস্তিষ্ককে হাই ওয়েভে রাখতে হয়েছে। ফলে মাথাটা বেশ ধরে গেল। এই ধরা মাথায়ও গল্প আমাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে? আসুন একটু আলাপ করি।

চরিত্রের চরিত্র

বলছিলাম পুরুষালি মেয়েটাকে দেখে ধাক্কা খেলাম। কেন পুরুষালি বলছি, সেই প্রসঙ্গটি একেবারে শেষে বলবো। আমার চারপাশে রেহানার মতো এমন নারীচরিত্র দেখছি না। অনেক ভেবেছি আছে কিনা। নাহ্, আমার ব্যার্থতা! একজনও খুঁজে পাইনি। যে ন্যায় নীতির প্রশ্নে এতোটা একরোখা, বিবেচনা আর বিবেকের দ্বারে প্রকট প্রকাণ্ড! তাহলে কে এই রেহানা মরিয়ম নূর? রেহানা মরিয়ম নূর আসলে একটা এক্সপেরিমেন্ট একটা এলিয়েন। যে আপনার মনে আছে আবার নাই। আপনি চাইলে আসে না চাইলে ফুড়ুৎ! পরিচালকের এই এক্সপেরিমেন্টটাই পুরো চলচ্চিত্রের প্রাণ। একজন পরিচালক একটা চলচ্চিত্রের পুরোটা জুড়ে এই এক্সপেরিমেন্টকে বিভিন্ন কম্প্রোমাইজড চরিত্রের পারিপার্শ্বিকতা দিয়ে আনকম্প্রোমাইজড করে তুলেছে। প্রতিটা ঘটনায় স্রোতের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে রেহানাকে, এবং দেখবার চেষ্টা করেছে, রেহানা মরিয়ম নূর কতোটা দূরে যেতে পারে। কান বলেন আর মাথা বলেন, সবাইকে এক বাক্যে বলতে হবে, পরিচালক যতোটা দূরে রেহানা মরিয়ম নূরে নিয়ে গেছেন তা অসামান্য। অন্তত বাংলা চলচ্চিত্র তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রে একটা দারুণ ঘটনা।

রেহানার চরিত্র বিশ্লেষণে আমার সাথে আপনার মতের অমিল হতেই পারে, তাও আমাকে আমার ভাবনাটাই বলতে হবে। কারণ বাস্তবিক রেহানা মরিয়ম নূর আমার চোখের সামনে না থাকলেও রেহানা মরিয়ম নূরকে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য অসংখ্য অনুঘটক চরিত্র আমার সামনেই আছে। যাদের সমষ্টিই মূলত রেহানা মরিয়ম নূর। যার প্রতিটা বেক্ষাপ্পা ব্যাপারগুলোর বিপ্রতীপ সমীকরণ। তাই এই সমীকরণের সমাধান টানবার প্রয়াস আমাদের একেবারেই নিজস্ব। পরিচালক আপনার চিন্তার শক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছেন। আর আপনার আমার সামনে একজন রেহানা মরিয়ম নূর প্রস্ফুটিত হয়েছে।

ঘটনার ঘটমান বাস্তবতা

আমার নিজের লেখা একটা কবিতা মনে পড়ছে।

ইচ্ছা নারী

পরের জন্মে আমি নারী হব

ঈশ্বরের দেয়া রেণুতে

গর্ভ দিবো শস্যদানা

আর পৃথিবী ভরে দেব প্রাণ-ফসলে

পরের জন্মে আমি নারী হব

নীরবে নদীর মতো প্রমত্তা হব

শূন্যের অসীম হব

সকল ঈশ্বরের পুত্রদের

মা হব আমি।

এইটা লেখার পিছনে আমি কয়েকটা বিষয় বিবেচনা করেছি। এক. আমি পুরুষ। দুই. আমি ক্ষমতাবান। তিন. এই সোসাইটি আমার মতের সাথে চলে। চার. রাষ্ট্র আমার পরিপূরক। পাঁচ. আমি এই নিরবিচ্ছিন্ন ক্ষমতারই অংশ। কিন্তু এসবের একটিও আমাকে টানে না। আমার বরং কোমলতা ভালো লাগে। শরীরে ভাঁজে ভাঁজে চৈতন্য খুঁজতে ইচ্ছা করে। ডুব মারতে ইচ্ছা করে মহা শরীরে। জন্ম দিতে ইচ্ছা করে শত সন্তানে প্রাণ। আমার ইচ্ছা করে আমাকে নিয়েই মহাপ্রেমের বিস্তার ঘটুক। আলোচনায় থাকি আমি। তাই আমি নারী হতে চেয়েছি।

কিন্তু, এই যে রূপকল্পনা সেই আমিও আমার পুরুষ ভিত থেকেই এর পরিকল্পনা করেছি, এই যা ব্যার্থতা! তাহলে রেহানা মরিয়ম নূূরে কী ঘটেছে? একটা বড় কমপ্লিকেসি তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয়েছে পরিচালক এটি সচেতনভাবেই করেছে। এই কমপ্লিকেসি তৈরি না করা হলে সিনেমাটা সিনেমা হয়ে উঠতো না। গল্প মেটাফোরে আবদ্ধ হত না। দর্শকশ্রেণি বোকাই থেকে যেত। তাই রেহানা মরিয়ম নূর কমপ্লিকেটেড ক্যারেক্টার। যে চরিত্রটি হয়তো আরাধ্য। অন্তত একটা লেভেল পর্যন্ত কাম্য।

এই ১১ নভেম্বর রাতে আমাদের নারীরা “শেকল ভাঙার পদযাত্রা” করেছেন। কী দারুণ ব্যাপার! তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিলেন- পুরুষের ক্ষমতা ভেঙে হোক সমতা!

এই দাবির সাথে রেহানা মরিয়ম নূরের অ্যাটেম্পটা মিলিয়ে দেখুন। দেখুন তো আপনি এইবার সমাজকে পেয়েছেন কিনা। বর্তমানকে পেয়েছেন কিনা। একটা পর্যায় পর্যন্ত তো পেয়েছেন। আপনার চোখের সামনে অন্তত রেহানা মরিয়ম নূরকে পেয়ে গেছেন। তাহলে চরিত্রের চরিত্র নিয়ে আলাপের সময় আমি যা বলেছি তা কি ভুল? না।

শেকল ভাঙার পদযাত্রার স্লোগান আর রেহানা মরিয়ম নূরের অ্যাটেম্পটকে আমি প্যারালাল দেখাতে চাইলেও ব্যাপারটা প্যারালাল না। কমন হলো, দুই ক্ষেত্রেই ক্ষমতার এনটিটিকে বাদ দিয়ে প্রতাবদী চেতনাকে সামনে আনা হয়েছে। কোনোটিই ক্ষমতার মূল চরিত্রকে ফোকাস করেনি। বরং ক্ষমতাকে পুরুষ দিয়ে জাস্টিফাই করা হয়েছে। যা আগের সময়কার আদিখ্যেতা আলোচনার মতোই এখনও বিদ্যমান বাস্তবতা। নিউ রিয়ালিজম এবং গ্লোবাল ভিলেজে ক্ষমতা বলতে এখন আর পুরুষকে মেনশন করে না বরং মেকানিজমকে সামনে আনে। আপনি হয়তো বলতে পারেন এই মেকানিজম তো পুরুষ করে। আমি বলবো, না। এই মেকানিজম একটা কালেক্টিভ পদ্ধতি। যেখানে দ্বন্দ্বের কোনো স্থান নেই। এটা নিরেট। এস্পার অথবা ওস্পার। এটা একটা ডাটাবেইজ। এই বেইজ ধরে আপনাকে সংখ্যা মিলিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। সো মেকানিজমে পুরুষ-নারী কেবল ক্রীড়ানক। তাহলে ক্ষমতাটা আসলে কি দাঁড়ালো? চক্র? কর্পোরেশন? বুর্জোয়া পুঁজিবাদ?

এসব প্রশ্ন কখনো মনে আসলে আমি উত্তর খুঁজবোই। তাই রেহানা মরিয়ম নূর কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন বারবার সেখান থেকে সরে এসেছে। কারণটা কী? অ্যানি, মিমি, আরেফিন স্যার, আয়েশা, প্রিন্সিপাল, মেয়ে, ভাই এইসব চরিত্র চলতি জীবনের পার্শ্বপ্রক্রিয়া বলে? নাকি, রেহানা একাই ১০০ হতে চেয়েছে। ভিকটিমের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার যে চেষ্টা এবং রেপিস্টের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি পাওয়ার একই চেষ্টা আমাকে তো সেই পুরুষালি রূপটাকেই আবার দেখিয়ে দিয়েছে। রেহানা মরিয়ম নূর কী জাজ?

টক ঝাল মিষ্টি ফলাফল

শুরুর দিকে বলেছিলাম, রেহানা মরিয়ম নূর একটা এক্সপেরিমেন্ট একটা এলিয়েন। যে আপনার মনে আছে আবার নাই। আপনি চাইলে আসে না চাইলে ফুড়ুৎ! এই যেমন- সে মেয়েকে খেলার সমতা নিয়ে বলেছে, স্কুলে চিমটি কামড় নিয়ে সমতা খুঁজেছে, অ্যাবিউজকে টেনে এনেছে, মেয়ের জন্য দাঁড়িয়েছে, আরেফিন স্যারের হঠাৎ তুমি সম্বোধনে নেমে আসার বিপরীতে সোজা সাপটা না কে না শব্দ দিয়ে প্রকাশ না করেও না বলে দিয়েছে। কলাপসিবল গেটে আটকা পড়ার পর শিক্ষার্থীদের সাথে সরাসরি নিজে কথা বলেছে কিন্তু তাও একজন রেপিস্টের সাথে আঁতাত করেনি। প্রিন্সিপাল মিডলম্যান হয়ে অন্যায়কে ঢাকতে নানা কসরত করেও পারেনি। আবার ভাইয়ের সাথে আলোচনায় রেহানার চরিত্র হঠাৎই অযাচিতভাবে মূল স্রোত থেকে পড়ে গেছে। রেহানার চরিত্র দারুণভাবে মেয়ের চরিত্রে প্রভাব ফেলেছে। মাকে পাত্তা না দিয়ে অতোটুকুন মেয়ের দৌড়ে বের হয়ে স্কুলে ছুটে চলে যাবার মধ্যে যে প্রতিবাদ মূলত এটিই এই চলচ্চিত্রের মূল উপসংহার।

যদিও মেয়ে জানে না কেন মা তাকে স্কুলে যেতে বারবার বারণ করছে। মা চাইছে না তার মেয়ে সবার সামনে সরি বলুক। আবার মেয়ে চাইছে সে সবার সামনে পারর্ফম করবেই। মূলত রেহানা মরিয়ম নূর এই নায়ের মাধ্যমে আগামীর নারীকে প্রস্তুত করে দিলেন। এই একটি বিষয় দিয়েই পরিচালককে হ্যাটস অফ বলতে একটু দ্বিধাবোধ হওয়ার কথা না।

ব্রাহ্মণগিরি নাকি মুন্সিয়ানা

“একটা দেশে খাঁটি শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র তৈরি হবে কী করে, যদি তা সঠিকভাবে বোঝার মতোন দর্শক না থাকে? শুধু দু’চারজন বোদ্ধার জন্য ছবি তৈরি করা যায় না। চলচ্চিত্র একটি বৃহৎ শিল্প, বহু আয়োজন এবং পরিশ্রমের, যথেষ্ট জনসংবর্ধনা না পেলে এর স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে যায়। শিক্ষাহীন বা নিম্নরুচির মানুষের দেশে বোকা বোকা ছবি তৈরি হওয়াই নিয়ম।”

সত্যজিৎ রায় সম্পর্কিত কোনো একটি বইয়ের ফ্ল্যাপে এমন একটা লেখা পড়েছিলাম। লেখাটা মনে গেঁথে আছে। যদিও কথাটায় নিম্নরুচি আছে তবুও ভালো লেগেছে। নিম্নরুচির মনে হয়েছে, কারণ লেখক, দর্শককে আইডেন্টিফাই করতে চেয়েছে। আর এটিই প্রমাণ করে, ওই চুদির ভাই মানুষের সাথে কানেক্টেড না। বাংলাভাষার কতো মানুষ রবীন্দ্রনাথের নাম না শুনেই মরে গেছে। এই সময়েও কতো মানুষ রবীন্দ্রনাথকে চিনেও না। তাতে কি ওরা গান কবিতা ছড়া আলাপ ছাড়া বেঁচে আছে? না, কারণ মানুষ শিল্পেই বাঁচে। শিল্পে বাঁচার জন্য বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নাই। গ্রহণ করবার ক্যাপাসিটিটা থাকলেই হয়। একটা পাগলেরও গ্রহণ ক্যাপাসিটি আছে। আপনার কি একটা পাগলকে কানেক্ট করবার ক্যাপাসিটি আছে? সো দর্শককে জ্ঞান বিতরণ বন্ধ করুন। নিজেকে জাহির না করে এলিয়েন না বানিয়ে মানুষের ঘনিষ্ট করে তুলুন। জীবন না দেখে জীবন রচনা করবার কোনো মানে নাই। এইসব ফ্যালাসি বহুত হইছে, এইবার অফ যা ভাই অফ যা।

কিন্তু রেহানা মরিয়ম নূর কি এই ব্যাপারে অন্যদের থেকে অগ্রগণ্য কিংবা আলাদা হতে পেরেছে? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আমি সাম্প্রতিক দেখা অন্য একটি চলচ্চিত্রের কিছু কথা টানবো। ময়মনসিংহ গীতিকাকে বেইজ করে চন্দ্রাবতীর কথা বানালেন এন রাশেদ চৌধুরী। কী দারুণ ব্যাপার। চলচ্চিত্রটি নিঃসন্দেহে প্রামাণ্য দলিল। কিন্তু দর্শকশূন্য! কারণ কি? প্রথমে আমি ভেবেছিলাম মনে হয় লোকটা একাডেমিক রেফারেন্সের জন্য এই কষ্টটা করেছেন। কিন্তু পরে দেখলাম, আসলে তা নয়। মানুষের জন্যই কাজটা করেছেন। অথচ অবাক করা ব্যাপার পুরো সিনেমাটা বুঝতে আপনাকে পণ্ডিত না হলেও পণ্ডিতের সাগ্রেদ তো অন্তত হতেই হবে!

অথচ কী দারুণ একটা রেফারেন্সকে বেইজ করে নির্মাণ চেষ্টা। যে শব্দগুলো বাংলাদেশর মানুষের এক সময়কার ঠোঁটে ঠোঁটে। গল্পগুলো কমবেশি পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছেই নানাভাবে পরিচিত তারপরও সিনেমাটা আপনাকে ধরতে গিয়ে নানা কসরত করতে হচ্ছে।

রেহানা মরিয়ম নূরে অ্যানি ভিকটিম আবার প্রতিবাদহীন তারুণ্য, আরেফিন স্যার রেপিস্ট এবং ক্ষমতায় ঋষ্টপুষ্ট, প্রিন্সিপাল মিডলম্যান দালাল, মিমি চরিত্রহীন সমাজের চরিত্রহীন পানি যে পাত্রে রাখে সে পাত্রের আকার ধারণ করবে, আয়েশা সহজবোধ্য আবার হায় হায় দুর্গম, ইমু প্রতাবদী সম্ভাব্য আগামী। আর এসব কিছু ছাপিয়ে এক্সপেরিমেন্টাল এলিয়েনটাইপো রেহানা। রেহানা কি অতিচরিত্রায়ন হয়ে গেছে কিনা সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করতেই পারি। কী কারণে রেহানা সদা সর্বদা বিধ্বস্ত? যদিও এর উত্তর আপনি নিখুঁতভাবে সিনেমাটা দেখলে পেয়ে যাবেন। কারণা রেহানা তো আর একা রেহানা নয়।

চোখকচলানি

আচ্ছা ভাই, কেউ আমারে কউ তো মাইনষ্যের চোখ কি ডানে বামে দোলে? একবার ডানে কাইত একবার বামে কাইত? চোখ তো একটা রিলিফ ভিউ খোঁজে? ইদানিং দেখি আজাইরা হেলানি দুলানি জার্কিং হাতের উপ্রে গিমবেলে শট নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বাপ চোখের উপ্রে কোনো গ্রামার নাই। তুমি যদি দৌড়ায়া গিয়াও কাউরে ফলো করো তাতেও আপস ডাউন হবে। হ্যাঁ, বলতেই পারো এইটা মোমেন্টামকে এস্টাব্লিশ করছে, সিগনিফিকন্ট নিউ রিয়ালিস্টিক ট্রিটমেন্ট দিছো কারণ ফিল্মেরও কোনো গ্রামার নাই। ওকে, কিন্তু রিলিফ তো থাকতে হবে, তাই একটু রিলিফ ওয়ার্ক করলে সমস্যাটা কি? তাতেও প্লটের আসকিং রেসিও কমে যেত বলে মনে হয় না। আবহ বেকগ্রাউন্ড ফলির জয় জয়কার। যেটি চন্দ্রাবতীর কথাতেও দেখেছি। তারমানে এইসব জায়গায় আমাদের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।

সাম্পাদনায় দারুণ স্বকীয়তা পেয়েছে রেহানা মরিয়ম নূর।

এইটা দেখার বিষয় যে সিনের পরে সিনে ঢুকার জন্য একজেক্ট কাট টা কী দারুণভাবে অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। ইশ্! কিছু বাড়তি টাকা থাকলে লোকটারে আজই পানি-পুনি পান করায়া আসতাম! অনেকদিন পর এমন পরিকল্পিত মাস্টারিং দেখলাম। প্রজেকশনের বাস্তবতার কারণে কালার নিয়া কথা বলতে পারলাম না। এর জন্য দায়ী স্টার সিনেপ্লেক্স অথরিটি। রেহানা মরিয়ম নূরের মতো অটল চরিত্র হইলে আজই মামলা করে দিতাম সিনেপ্লেক্সের বিরুদ্ধে। সে যাই হোক না কেন, অনেকদিন পর ভালো কইরা চোখ কচলাইছি। ভাল্লাগছে, ভালো লাগার চোদনে এতো বড় একটা রচনা লেইখা ফেলাইছি। 😆

বাঁধন হারা বাঁধন

চরিত্রের সাথে কী দারুণ মার্চিং! প্রতিটা নিঃশ্বাসে তা টের পেয়েছি। এতোটুকু ছাড়া দেয়নি। কোথাও কোনো মিসলিড হয়নি। আপনার চোখে আমরা আমাদের চলচ্চিত্রের সুন্দর আগামী দেখেছি। আপনার জন্য নিরন্তর ভালোবাসা। পরের জন্মে যদি নারী হয়ে জন্মাই আপনার মতো এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করবো।

হোঁচট

দারুণ নির্মাণ দারুণভাবে হতাশ করবে এইটা খুব স্বাভাবিক। তাই হোঁচট খেতেই হলো।

এইটা ঠিক যে সিনেমায় রাজনীতিটা থাকতে হবে। সেইটা গল্পের সাথে হোক কিংবা চরিত্রের অবয়বে হোক উপস্থাপন করতেই হবে। সাধারণত নির্মাতারা এই ব্যাপারটাকে বেশ ভালোভাবেই রাখতে চান। কিন্তু এর মানে এই নয় আপনি আপনার টেক্সট অর্ডার ঠিক রাখবেন না। অপরিনামদর্শীতা চাপিয়ে দিবেন।

ছোটবেলায় বিটিভিতে ইরানি চলচ্চিত্রের বাংলা ডাবিং দেখতাম। এখনও মনে পড়ে। যতোদূর মনে পড়ে, আমি মনে হয় রেহানা মরিয়ম নূরকে সেখানেই প্রথম দেখেছি। হয়তো এ কারণেই আমি হোচট খেয়েছি। কারণ এই রেহানা মরিয়ম নূরের পোশাকি অবয়ব আমি সেই ইরানি চলচ্চিত্রের নারীতে দেখেছি। তারমানে পরিচালক এখানে বায়াস্ট। তাছাড়া, পরিচালক অটল চরিত্রের রেহানা মরিয়ম নূরকে কেমন হতে হবে তার রূপকও দিয়েছেন- জিন্স এবং হিজাবি রেহানা মরিয়ম নূরকে দিয়ে। শুধু তাই নয় ব্যালেন্স করবার জন্য প্রিন্সিপালকে বানিয়েছেন হিন্দু হিসাবে, এবং দেখিয়েছেন মিডলম্যান দালাল হিসাবে। অর্থাৎ এই সমাজে হিন্দুর কোনো মেরুদণ্ড নাই এইটা এই চরিত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে। এবং আমাদের আরাধ্য প্রতিবাদী রেহানা মরিয়ম নূর হবে আমার অচেনা একজন হিজাবি রেহানা মরিয়ম নূর। শুধু কি তাই পরিচালক আরো ঘণ্টা বাজায়া দিছে। একটা সিনে মায়ের ধমক খেয়ে ইমু গিয়ে বসে চেয়ারে। সেই সিনে ইমুর প্যারালাল একটা জায়নামাজকে কী অবলীলায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এবং চিন্তার সাথে এক্সপোজ করা হয়েছে। একটা ফ্রেমে কী ভয়ঙ্কর অদ্ভুত আগামী দেখানো হয়েছে!

আরো আছে ভাই, এই যে এতো ইনডোর ইনডোর শ্যুটিংয়ের কথা বলা হইলো, অথচ রেহানা অসুস্থ হওয়ার পর, তাকে দেখতে আসা আত্মীয় ভাই মেয়ের আলোচনার সময় একটা গানকে খুব মৃদু ডিবিতে সাজেস্ট করা হয়েছে। দুইটা কারণ হতে পারে, এক দেশের মানুষকে ভুলভাবে উপস্থাপন অথবা দেশের ম্যাক্সিমামের বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে একটা সিম্বলিক রিলিফ আনা। কিন্তু এখানে কোনো যুক্তি ছাড়াই ব্যাপারটা ঘটেছে। যুক্তি থাকলেও আমার চোখে হয়তো ধরা পড়েনি। বাট এইটা রাজনীতির বদলে অপরাজনীতি হয়ে গেছে।

এর মানে হলো, হয় পরিচালক কোনো গোষ্ঠির মদদপুষ্ট অথবা রাজনৈতিক বোধশূন্য। যা খুবই হতাশার। কারণ পশ্চিমাবিশ্ব সবসময় ডমিনেট করতে চেয়েছে। সো ওয়েল অর্গানাইজড ইনফো পাস করবার জন্য সে তোমাকে শুধু পুরস্কারই না চুমোটুমো দিতে আপত্তি করবে না।

শুরুর দিকে বলছিলাম পুরুষালি মেয়েটাকে দেখে ধাক্কা খেলাম। তো রেহানা মরিয়ম নূরকে কেন পুরুষালি বলছি? রেহানা তার চরিত্রে অটল হলেও সে বারবার অ্যাবিউসিভ ক্যারেক্টারের মতোই আচরণ করবার চেষ্টা করেছে। এবং ভিকটিম এবং রেপিস্টের মুখ থেকে শোনবার চেষ্টা করেছে। একজন ডাক্তার ভালো করেই জানেন ভিকটিমের মনস্তত্ত্ব কেমন হতে পারে। তাই এমন অপ্রাসঙ্গিকতাকে এস্টাব্লিশ করে গল্পকে লেন্থি করা হয়েছে। আবার রেপিস্টের কাছ থেকে বারবার স্বীকারোক্তিমূলক ব্যাখ্যা শুনতে চেয়েছে। এবং কেন সে সেটি শুনতে চায় তা পুরো সিনেমার কোথাও স্পষ্ট না, যেখানে রেহানা জানে মিডলম্যান হিসাবে প্রিন্সিপাল তাকে নিবৃত করবার চেষ্টা করছে। আবার ভিকটিমও এই ব্যাপারে কোনো স্টেপে এগুতে চাইছে না। ইভেন রেহানা নিজেও জানে না এরপর সে কী করবে, মামলা নাকি অন্য কিছু আনপ্রেডিক্টেবল! বরং মনে হয়েছে, এইটা জানবার পর রেহানা মরিয়ম নূর আসলে পুরুষের মতোই একটা সুখানুভূতি কিংবা আনন্দ পেত।

সেদিকে নিজের মেয়ের সাথে যে অ্যাবিউসিভ অ্যাটাচমেন্ট দেখানো হয়েছে তা ভয়াবহ। যদিও দরজা লাগিয়ে মেয়েকে আটকে রাখা এবং মেয়ের মা মা বলে দরজা খুলে দেয়ার আকুতির মধ্য দিয়ে পরিচালক নিজেকে এবং দর্শককে নিস্তার দিয়েছে। কারণ এই মা ডাকার মধ্য দিয়ে কয়েকটা বিষয় মাথায় অনুরণন ঘটিয়েছে,

এক. মা তুমিই আমার ত্রাতা

দুই, মা তোমাতেই আমার মুক্তি

তিন. মা তুমিই পারো আগুনের ফুল্কি উড়াতে

সো এই জায়গায় তো পরিচালক মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেনই। তাই আসুন পুরো টিমকে অভিবাদন জানাই। এতে আপনি ছোট হবেন না বরং পরিচালক হিসাবে সাদের সাথে আপনিও দর্শক হিসাবে বড় হবেন।

যা কিছু ভালু তার সাথে প্রথমালু

এই মার্কেটিংটা করেন নাই তাই আনন্দ পেয়েছি। এইসব ফালতু ক্যাটাগরাইজড সিন্ডিকেটবাজির বাইরে আমাদের একজন পরিচালক আছে, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, এতো আমাদের পরম পাওয়া বলেই মনে করছি (যদিও এই কথাটা যে কোনো সময় ভুল প্রমাণ হতে পারে)। আপনার এবং আপনার টিমের সম্মানার্থে আজ দুই প্যাগ মারবো আশা রাখি। আপনার নির্মাণে শক্তি পেয়েছি। আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো সাদের মাধ্যমে, এইটাই এখন প্রকৃত। অ্যান্ড স্যালুট টু ইউ ম্যান, লাভ ইউ রেহানা মরিয়ম নূর।

রেহানা মরিয়ম নূর নিয়ে এই রিভিউটি লিখেছেন মেহেদী হাসান স্বাধীন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top