“শিল্পীর মৌলিক দায়িত্ব হলো সত্য বলা, যতই সেটি অস্বস্তিকর হোক।”

বাংলাদেশের নাট্যকর্মী
এহসানুল আজিজ বাবু

Table of Contents

অন্ধকারের মাঝে মঞ্চ: বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের করণীয়

বাংলাদেশের মঞ্চ আজ এক সঙ্কটে দাঁড়িয়ে—যেখানে আলো নিভে যাচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন জেগে উঠছে বারবার। একসময় যেই নাটক ছিল প্রতিবাদের ভাষা, মানবতার প্রতিধ্বনি, আজ তা বন্দি হয়ে পড়েছে প্রশাসনিক অনুমতি, রাজনৈতিক চাপ আর অর্থহীন উৎসবের খাঁচায়।

“মঞ্চ নিভে গেলেও আলো নিভে যায় না।”

এহসানুল আজিজ বাবুর এই প্রবন্ধ আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই চিরন্তন প্রশ্নে—আজ যখন চারপাশে নীরবতার প্রাচীর, তখন নাট্যকর্মীর ভূমিকা কী হবে? তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে সাহস, সৃজনশীলতা ও নৈতিক বোধ দিয়েই অন্ধকারের ভেতর জ্বালানো যায় আলো। পুরো লেখাটি পড়ে আমরা তারই ইঙ্গিত পাই। –বোকা


অন্ধকারে মঞ্চের ভূমিকা

মঞ্চ শুধু কাঠ, কাপড় ও আলো নয়; এটি একটি আয়না, যেখানে সমাজের প্রতিফলন দেখা যায়।
আজকের বাংলাদেশ যেন সেই অন্ধকারের আয়নায় বন্দি—ভয়, দুর্নীতি, সেন্সরশিপ ও নীরবতার ছায়া ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। মানুষ দর্শক হয়ে থাকে, কিন্তু কথা বলার অধিকার হারায়।

“আমি কি এই অন্ধকারে নীরব থাকব, নাকি প্রতিবাদের শিখায় নিজেকে জ্বালাব?”

থিয়েটার কেবল বিনোদন নয়; এটি প্রতিবাদ, চিন্তা ও নৈতিকতার আলো। এক সংলাপ, এক দৃশ্য বা একটি নীরব মুহূর্ত মানুষের হৃদয়ে আগুন জ্বালাতে পারে।


অচল মঞ্চে দেশের প্রতিচ্ছবি

বাংলাদেশ আজ যেন এক বিরাট নাট্যমঞ্চ—যেখানে ক্ষমতা, রাজনীতি ও স্বার্থের নাটকে মানুষ কেবল দর্শক, কিন্তু কথা বলার সুযোগহীন।
রাষ্ট্রের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, সেন্সরশিপ ও বুদ্ধিজীবী নীরবতা মিলে যেন তৈরি হয়েছে এক অদৃশ্য দমনযন্ত্র।

নাট্যচর্চা, যা একদিন মানুষের চেতনা জাগানোর হাতিয়ার ছিল, তা আজ প্রশাসনিক অনুমতি, সরকারি অনুদান ও নিরাপদ নীরবতার খাঁচায় সীমিত হয়ে পড়েছে।

“যখন সমাজে অন্ধকার নামে, তখন প্রথম আলো জ্বলে মঞ্চেই।”

মঞ্চের কাজ: প্রতিবাদের ভাষা

নাটক শুধু বিনোদন নয়; এটি সামাজিক আত্মার প্রতিধ্বনি।
নাট্যকর্মীর দায়িত্ব কেবল সংলাপ বলা নয়, বরং দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগানো—

“আমি কি সত্যিই ন্যায়ের পাশে দাঁড়াই?”

প্রতিটি সংলাপ নৈতিক বিপ্লব, প্রতিটি দৃশ্য অস্থির বিবেকের প্রতিফলন।
মঞ্চে যখন এক চরিত্র ন্যায়ের জন্য চিৎকার করে, তখন সেই কণ্ঠ হয়ে ওঠে হাজার মানুষের নীরব প্রতিবাদ।


থিয়েটারের শত্রু: মুখোশ ও নীরবতা

আজকের থিয়েটারে সবচেয়ে বড় বিপদ অর্থাভাব নয়, বরং সাহসের অভাব।
মুখোশধারী শিল্পী, আপোষকামী দল, মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবী—যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংলাপ উচ্চারণ করতে ভয় পান।

“শিল্পীর মৌলিক দায়িত্ব হলো সত্য বলা, যতই সেটি অস্বস্তিকর হোক।”

মঞ্চ নাটকের নৈরাজ্য ও সমাধানের পথ

মূল সমস্যা:

  • সাংগঠনিক অপ্রতুলতা ও অনিয়ম: অভ্যন্তরীণ বিভাজন, দুর্নীতি, অযোগ্য নেতৃত্ব, নতুন শিল্পীদের সুযোগ সীমিত।

  • অর্থ ও উৎসাহের অভাব: অনুদান কম বা দেরিতে পাওয়া, হতাশা ও উদ্দীপনার অভাব।

  • সৃজনশীল স্বাধীনতার হানি: সেন্সরশিপ ও রাজনৈতিক চাপ, আপোষমূলক নাটক।

  • প্রজন্মের সংযোগের অভাব: নতুন দর্শক ও শিল্পীর সম্পৃক্তি কম, নাট্যশিক্ষার অভাব।

নিরসনের উপায়:

১. সাংগঠনিক সংস্কার: স্বচ্ছ ও দক্ষ নেতৃত্ব, নিয়মিত অর্থায়ন ও অনুদান বিতরণ।

২. সৃজনশীল স্বাধীনতার প্রতিরক্ষা: সাহসী, প্রতিবাদী নাট্যকর্মী।

৩. জনতার সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি: গ্রাম, কলেজ, শ্রমিক কলোনি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক প্রচার।

৪. শিক্ষা ও নাট্যচর্চার সমন্বয়: নাট্যশিক্ষা বাধ্যতামূলক, সমাজবোধ ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি।

৫. আন্তর্জাতিক সংযোগ ও অভিজ্ঞতা: বিদেশি নাট্যচেতনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন দর্শন তৈরি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: মঞ্চের প্রেরণা

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল মানুষের মর্যাদা, ন্যায় ও সত্যের লড়াই।
আজ সেই চেতনা থিয়েটারে পুনরুজ্জীবিত হওয়া প্রয়োজন।

মঞ্চ হতে পারে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র:

  • নাট্যকর্মী অস্ত্র নয়, সংলাপ ধারণ করে;

  • আলো প্রতিবাদের প্রতীক;

  • শিল্প মানুষকে চিনতে শেখায়।

“ভয়কে নয়, ভয়ের বিরুদ্ধেই দাঁড়াও।”

সাংস্কৃতিক জাগরণ ও শিক্ষানীতি

নাটক মানুষের মনোজগতে আলোড়ন তোলে, চিন্তা ও বিবেককে জাগ্রত করে।
শিক্ষা চিন্তাশীল নাগরিক তৈরি করে, নাটক সেই চিন্তাকে মানবিক শক্তিতে রূপ দেয়।

“একটি জাতি যতই শিক্ষিত হোক, যদি সংস্কৃতিতে জাগরণ না ঘটে, তবে সেই শিক্ষা হবে যান্ত্রিক।”


নাট্যকর্মীর করণীয়

১. প্রতিবাদী নাট্যচর্চা: অন্যায়, দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা, নারী-অবমাননার বিরুদ্ধে।

২. জনতার সঙ্গে সংযোগ: গ্রাম, কলোনি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক পৌঁছে দেওয়া।

৩. নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করা: তরুণদের সাহস ও সৃজনশীলতা মঞ্চে আনা।

৪. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানো: স্বাধীনতার ভাবনা বাস্তব সংগ্রামের শক্তি হোক।

৫. আন্তর্জাতিক সংলাপ: বিদেশি নাট্যচেতনা থেকে নতুন ভাষা ও দর্শন তৈরি।

মঞ্চের আলো: নৈতিক সাহসের প্রতীক

  • সত্য উচ্চারণকারী নাট্যকর্মী কেবল শিল্পী নয়—সামাজিক যোদ্ধা।

  • মঞ্চ হলো নৈতিক মানচিত্র।

  • আলো নিভে যাওয়ার পরও সংলাপ মানুষের বিবেক নাড়াবে।

“আমি কি এই অন্ধকারে নীরব থাকব?”

মঞ্চের ভবিষ্যৎ, আলোর ভবিষ্যৎ

অন্ধকার যত গভীর হবে, নাট্যকর্মীর দায় তত বাড়বে।
থিয়েটার কেবল শিল্প নয়—এটি মানুষের আত্মার প্রতিবাদ, সত্যের সংলাপ, ন্যায়ের উচ্চারণ।

আজ যদি নাট্যকর্মীরা সাহসের সঙ্গে দাঁড়ায়, মুখোশধারী সমাজের মুখ উন্মোচন করে, এবং মানুষের পক্ষে সত্য উচ্চারণ করে—
তাহলে একদিন মঞ্চই হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোকিত স্থান।

সেই মঞ্চে অন্ধকার থাকবে না—
থাকবে আলো, ন্যায়, শিক্ষা ও মানবিকতার পুনর্জন্ম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top