হোসনে আরা জেমী: কবিতার ভুবনে এক যাত্রী

হোসনে আরা জেমী
হোসনে আরা জেমী

হোসনে আরা জেমী একাধারে লেখক, আবৃত্তিশিল্পী আর সমাজকর্মী। 

হোসনে আরা জেমীর কবিতা যেন ব্যক্তিগত দিনলিপি, আবার নারীর সমষ্টিগত  জীবনেরও অনুবাদ। তার কলমে ধরা পড়ে শৈশবের খেলা, কৈশোরের ঘেরাটোপ, এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে চলা, কিংবা প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতা। তিনি লিখেন, স্মৃতির ভাঙাচোরা ইট দিয়ে, আবার গড়ে তোলেন নতুন আকাশের স্বপ্ন।

জেমীর কবিতায় নারীর জন্ম যেন শুরু হয় কাঁটা দিয়ে, কিন্তু সেই কাঁটাতেই তিনি নিজের শক্তি খুঁজে নেন। কখনো তিনি লিখেন- নির্বাসনের গল্প, কখনো ভালোবাসার হারানো শব্দের সন্ধান। টরোন্টো থেকে লিখলেও তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে আসে করোতোয়ার ঘ্রাণ, মফস্বলের পথ, শৈশবের রোদ্দুর।

‘বদলে গেছে পরিচয়’, ‘একটা মেয়ে জন্মায় কাঁটা দিয়ে’ বা ‘ছায়াচিত্র’— প্রতিটি কবিতাই যেন জীবনের একেকটি আয়না, যেখানে আলো-অন্ধকার, বেদনা-আশা মিলেমিশে তৈরি হয় ভিন্ন এক দৃশ্যপট। হোসনে আরা জেমী কেবল লিখেন না, বরং জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা অনুচ্চারিত কথাগুলোকে কণ্ঠ দেন।

বোকায় স্বাগতম হোসনে আরা জেমীকে। বোকা তার একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করছে।

তার কবিতাগুলোয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠেছে আমাদের সবার গল্প।

Table of Contents

একটা মেয়ে জন্মায় কাঁটা দিয়ে

হোসনে আরা জেমী

একটা মেয়ে যখন জন্ম নেয়,
তখন হাসপাতালের শীতল ঘরে
কেউ বলে না— “বাহ্, রাজকন্যা এসেছে!”

তাকে ওড়না দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় আগে,
তারপর জন্মনিয়ন্ত্রণ শেখানো হয়
বয়স ৮-এ।

তার হাঁটুতে থাকে সতর্কতা,
তার চোখে থাকে ‘না’ বলার ভয়।
সে হাঁটে কিন্তু দেখে নেয় কারা কারা তাকিয়ে আছে।
সে পড়ে—কিন্তু বইয়ের পেছনেও
লুকিয়ে রাখে একটা সিঁধ কাটা চাবি।

তার জন্ম হয়
কাঁটা দিয়ে—
যাতে সে ফুল হয়ে উঠতে না পারে সহজে।

তবু সেই কাঁটা দিয়েই
সে নিজেকে তীক্ষ্ণ করে তোলে,
একদিন কবিতায় লিখে ফেলে নিজের শরীরের মানচিত্র—
তখন কেউ বুঝতে পারে না,
এই মেয়ে তো আগুন হয়ে উঠেছে!

হোসনে আরা জেমী
হোসনে আরা জেমীর প্রকাশিত বইগুলো
যদি দেখা হয়

হোসনে আরা জেমী

এখানে নয়, কোন এক নতুন পৃথিবীতে
আবার যদি দেখা হয়
আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে গুনবো সপ্ত আকাশের তারা
শরৎ এর আকাশে খুঁজে নবো স্বপ্ন কারুকাজ।

নীলহীন শরৎ খুঁজবে বিষন্নতার নীল
দূর মাহাশূন্য থেকে ভেসে আসবে মায়াবী সুর
পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসবে ঝর্না প্রবাহ
সমুদ্রতটে শুনেবো শঙ্কের নিনাদ,।
ঝিঝি পোকার গান
আর কিছু সবুজ ছুঁয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি।
আহত হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনাবে হারিয়ে যাওয়া কতকথা
ফেলা আসা অলি-গলিতে খুঁজে ফিরবে আঁষটে গল্পের ঘ্রান
ইতিহাস থেকে খুঁজে নেবে রূপকথা।

আবেদন

হোসেন আরা জেমী

আমার আবেদন পৌঁছে দিও
নদী, সাগর, পাহাড় কিংবা করোতোয়র জলের ডুবসাঁতারের কাছে
কৈশোরের একটিপ দুইটিপ খেলা, ফুল চুরি
ঝাঁঝালো রোদ্দুরে মচমচে পাতা মাড়িয়ে
চলে যাওয়া অবলীলায়,
খেলেছো সরিষা ফুলের মাতাল গন্ধে
ছুটেছো বর্ণালী প্রজাপতির পিছু পিছু
আর কোচর ভরে তুলে এনেছো কাঁচ ফুল
মালা গেথে গলায় পড়বো বলে।

রাত পেড়িয়ে ছুটে গেছি ভোরের তপনের কাছে
মিঠে রোদের কড়ানাড়া শুনতে
কী ছিলো কি ছিলোনা জানা হয়নি

স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ
কলেজ পেরিয়ে করোতোয়ার আল ধরে
হেঁটেছি শহরের এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে
গোটা শহর ঘুরেছি হুডতোলা রিকশায়
গোটা শহরের আনাচ কানাচে পায়ের চিহ্ন ফেলে রেখেছি
ধরে রাখতে পারেনি আমায় আমার প্রিয় শহর
পালিয়েছি জীবন  জীবিকার  সন্ধ্যানে
এক শহর থেকে অন্য শহর
দেশ থেকে অন্যদেশে
তারপরও
দৃঢ়তা পেয়েছে পদচ্ছাপ
চারিদিকে অন্ধকার
মনজুড়ে হাহাকার ছেড়ে আসা শহরের জন্য…

ছায়াচিত্র

হোসেন আরা জেমী

রাতের আকাশ থেকে জোছনা সরে গিয়ে
অমাবস্যার আগমন 
শুন্যতা কাঁদবে
তুষারে ঢাকবে গাছ, পথ, দেউড়ি
রোদহীন হবে জীবন
তুষার ঝাপটায় দমবন্ধ
নিঃশ্বাস ফেলছি দ্রুত
হঠাৎ জোছনার বিস্ফারণ
হৃদয় ধুঁকছে  কান্নাগুলো শূন্যে হারাচ্ছে
আলো ফিরিয়ে দিচ্ছে অস্তিত্ব
বিলীন হতে  ফিরি মাটির কাছে
রাত উত্তীর্ণ হয় নিয়ন আলো ছায়া-চিত্রে।
অনুভূতি  লুকিয়ে থাকছে মনের কোনে
নিঃশ্বাস হারাচ্ছে দেহের ওপারে

মেঘগুলি ভারী হয়ে বৃষ্টির আনাগোনা
স্বর্গজুড়ে নানা বর্ণের খেলা
অন্ধকার ধীরে ধীরে ধূসর  কালো ।
বিপথগামী আগামী কড়া নারে দোড়গোরায়
শীতের রাজত্বে দীর্ঘদিনের নিষ্ঠুরতা
নির্দয় হতাশারা আঁকড়ে থাকে জীবন।

ছুটে চলা

হোসেন আরা জেমী

বাঁচার লড়াইয়ে ছুটছি
গ্রাম থেকে গ্রামে
শহর থেকে শহরে
দেশ থেকে দেশে
দেশ থেকে পরদেশে
থামে না এই ছুটে চলা
হঠাৎ থমকে যায় সময়,
হারিয়ে যায় মানুষ
জমতে থাকে স্মৃতিকথা।

নতুন গ্রাম নতুন শহর
নতুন দেশ, নতুন  আশা
নতুন গল্প
পেছনের গল্প ফেলে
নতুন গল্পের প্লট
পেছনে ফেলে আসা
দিন, মাস, বছর, যুগ ফেলে
বর্তমানে আটকে থাকা।

মেঘের ওপারে মেঘ

হোসেন আরা জেমী

আকাশের অপারে আকাশ
তার ওপারে সপ্ত আকাশ!

এই যে সামনে বালিয়াড়ি
তারপর বিস্তৃত জলরাশি
তাঁকে  কি সমুদ্র বলো?
তার ওপারে কি থাকে
আমার জানা নেই
তোমার আছে জানা!!

মেঘের ওপারে মেঘ,
কালো মেঘে বৃষ্টি!

পৃথিবীর পরে অন্য পৃথিবী
আদিগন্ত  অন্যভূবন
মনের গহীনে মন
কেমন আছে মন
বুঝবো কি করে!

আকাশের ওপারে আকাশ
এই যে সমুদ্র, মেঘ, পৃথিবী
বুঝি না কিছু এই জাগতিক দুনিয়ায়!

ভুল শব্দ

হোসেন আরা জেমী

কিছু কিছু শব্দ ভুলে যেতে হয়
ফেলে দিতে হয় নদীর বাঁকে
জীবন স্রোতে হারিয়ে যায় শব্দ সম্ভার
কোনো একদিন যদি ফিরে আসে
শব্দগুলোকে ভেবে লিখতে হবে নতুন শব্দ
শুনতে হবে শব্দের দ্যোতনা।

নদী যখন কথা বলে তার কলধ্বনিতে
ফিরিয়ে দেয় জলের ঘূর্ণন
ফিরিয়ে দেয় কুল উপচানো জলের তোড়
ভেসে যায় ভালোবাসার ঘর দোড়।

সেখানে জন্ম নেয় নতুন ভালোবাসার হৃৎস্পন্দন
নতুন ঘর, নতুন প্রেমের বসত বাড়ি
সেখানে দেখা মেলে ফেলে আসা শব্দের কলতান।।

বদলে গেছে পরিচয়

হোসনে  আরা জেমী

আমি মানবিক মানুষ হতে চেয়েছি
আমার শৈশব – কৌশোরের বেড়ে উঠা যে ঘর সে আমার নয়
আমারা বলি পিত্রালয় সে ঘর থেকে আমি যেমন নির্বাসিত 
তেমনি আমার মা নির্বাসিত তার পিত্রালয়  থেকে
ভালো করে বুঝে উঠার আগেই
অন্য ঘরের  দ্বায়িত্ব  কাঁধেচাপা।

আমি সেই মানবিক মানুষ
আনি সেই মা, কন্যা
আমার বাল্যকাল কেটেছে মায়ের স্নেহ, বাবার আদর আর বোনেদের স্নেহ ভালোবাসায়
আমার মেয়েবেলায় পরেছে হাজার শৃঙ্খল
সন্ধ্যে হলে বাড়ি ফেরো,  ছেলে বন্ধুদের এড়িয়ে চলো।
আমাকে নিয়ে লেখা হয়নি অমর কবিতা
শুধু বদলে গেছে পরিচয়
মেয়ে থেকে বউ
বউ থেকে মা
মা থেকে শাশুড়ি, কখনো  প্রেমিকা, প্রেয়সী।
এইভাবে হাত বদল হতে হতে
আমি হয়ে গেছি একজন মা
একজন নারী।

বদলে যাচ্ছি

হারিয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন
নাকি বদলে যাচ্ছি !
কচ্ছপ  যেমন আপন খোলসে ঢুকে পরে
তেমনি করে দিনকে দিন আপন খোলসে ঢুকে পড়ছি
ভালো কথা, মন্দ কথা খোলস ভেদ করে
অন্তর ছুঁয়ে যায় না
চোখ দিয়ে আস্বাদন করি অন্তর ছোঁয় না 
শক্ত প্রলেপ  ভেদ করে দুঃখ ছুঁয়ে  দিতে পার যদি এসো…

হোসনে আরা জেমীর কবিতা এক অন্তহীন যাত্রা। স্মৃতি, বেদনা, প্রেম আর নির্বাসনের এক ছায়া, যেন আর অন্য কারো সাথে মিশে আছে।

জেমী যে-শহর ছেড়েছেন, যে-মানুষ হারিয়েছেন, যে-অভিমান বুকে বয়ে চলেছেন—সবই তার কবিতায় ফিরে আসে অচেনা রূপে। হয়তো এ কারণেই তার শব্দ এত আপন মনে হয়; বোকার পাঠকের বুকের ভেতরেও যেন বাজতে থাকে একই সুর।

জেমীর কবিতা ভাঙা স্বপ্নের মধ্যে দাঁড়িয়ে জীবনের নতুন মানচিত্র আঁকার চেষ্টা। নারীর শৃঙ্খল, প্রবাসের হাহাকার, ভালোবাসার আকুতি কিংবা অজানা আকাশের ডাক—সবই তার কবিতার ভাষায় ধরা দেয় নিঃশব্দ অথচ প্রবল আবেগে। 

জেমী যেন আমাদের শোনাতে চান, জীবন যতই ছুটে যাক, যতই বদলে যাক, স্মৃতি আর অনুভূতি কখনো মুছে যায় না; বরং নতুন আলোয় ফিরে আসে।

তার কবিতা তাই শুধু পাঠ নয়, এক অভিজ্ঞতা—
যেখানে নিজেকেও খুঁজে পাওয়া যায়, আর মানুষের ভেতরের সত্যটুকু নতুন করে জেগে ওঠে। -বোকা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top