শেষদিনে প্রাণ জুড়ালো বটতলা!

কোভিডের ক্লান্তির রেশ কোনো কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না। করোনায় আক্রান্ত না হলেও; মুখের উপর ঠোঁওয়া চাপাতে-চাপাতে একটা বিচ্ছিরী সময় পার করছি। সেই ২০২০ এর মার্চ-এপ্রিল থেকে। প্রতিদিন নানান সংকট সামনে এসে বিষন্ন করে দেয় আমাদের প্রতিটা দিন। আবার প্রতিদিন সংকটের পাশ কাটিয়ে বাঁচতে চাই আশার আলো জাগিয়ে। যদিও জানিনা এর শেষ কোথায়? এর শেষ কী আছে শেষদিনে?

এখনও জানিনা কেন আমাকে রেস করতে হচ্ছে? অথচ আমি তুমি আমরা সকলে জীবনের রেসে রেসের ঘোড়া হয়ে প্রতিযোগিতা করছি। ভাবি ‘এমন জীবন’ আমি আমার সন্তানের জন্য কী করে রেখে যাই?

প্রতিযোগিতা! প্রতিযোগিতা! প্রতিযোগিতা!

ঘরের খাট-পালঙ্ক থেকে শুরু করে গায়ের পারফিউমের গন্ধ পর্যন্ত আমাদের এই প্রতিযোগিতার জানান দিচ্ছে! ক’টাকা দামের চাল খাও মিয়া? ক’টাকার বিনিময়ে বিক্রি হও মিয়া? প্রতিযোগিতা! প্রতিযোগিতা! প্রতিযোগিতা! আমার হাসতে খুব ঘেন্না লাগে! রাস্তাঘাটে ফকিন্নি দেখলে খুব ঘেন্না লাগে! আসলে ঘেন্নাটা আমার নিজেকেই লাগে। কেন লাগে? চারপাশে এতো এতো অনিশ্চয়তা, অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছা বাসনা, অন্যায়, অবিচার, লোভ, উচ্চাসা আমার ভেতরে একটা গভীর আর জঘন্য রোগ তৈরি করেছে!

নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা এই দুটি শব্দ ভর করে থাকে মনে আর মগজে।

যারে ভালোবাসি, যারে শ্রদ্ধা করি, যার শাসনে ব্যাকুল থাকি সে কি জানে আমি তারে ভালোবাসি?

আজ ২০২১ সালের শেষ দিন। শেষদিনে পুরো বছরের মতো একই রোগের রাগে আক্রোশে আমি প্রায় শেষ। এর কোনো পথ্য আপাদত আমার নেই। কেন নেই? আরে ভাই আমি তো রেসের ঘোড়া না! তোমাদের চাপানো রেসটা বন্ধ করো, আমার রোগ সেরে যাবে! আজ দিনটায় হঠাৎই আমার রোগটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল! জীবনে প্রথমবারের মতো দুই ছেলেকে নিয়ে গেলাম থিয়েটার দেখতে। নাটকটা আসলে ওদের জন্যই, কিন্তু ওমা, গিয়ে দেখলাম এতো আমার জন্যও!

*** বটতলার ছায়ায় ***

দর্শক সারিতে বসে দুই ছেলে আর আমি বারবার তালি দিয়ে উঠি, চিৎকার দিয়ে উঠি। আমার ছেলেবেলার নির্ভার সুকুমার আর আমার ছেলেদের ছেলেবেলার স্বাপ্নিক সুকুমার একসাথে একাট্টা হয়ে আমাদের মন জাগিয়ে দিয়েছে। আমরা হাসতে হাসতে পল্টি খাচ্ছি। পাশের সিটের বাচ্চা বুড়োও যেন আমাদের সাথে হাসতে হাসতে ফেটে পড়ছে।

সুকুমার রায়-এর ‘হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ অবলম্বনে বটতলার দারুণ প্রযোজনা বন্যথেরিয়াম। কী দারুণ নাট্যরূপ আর নির্দেশনা দিয়েছেন ইভান রিয়াজ।

বন্যথেরিয়ামকে খুব সহজে পলিটিসাইজ করা যায়। খুব সমকালীন ঘটনা দিয়ে খণ্ডন করা যায়। বন্যথেরিয়ামে আমি হাসির খোরাক পেলেও আছে ভাবনার নিগূঢ়তা। যারা সুকুমারের হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন কী সিরিয়াস একটা রচনা। প্রফেসর হেঁসোরাম হুঁশিয়ার তার ডায়েরির কিছু পাতা উদ্ধার করে পাঠিয়েছেন, সেই গল্পের গল্পই হলো হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’র গল্প। একটা সময় সাহিত্যিকরা সিরিয়াস বিষয়কে রম্য করবার চেষ্টা করতেন। এই চেষ্টাটা বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘ সময়ের চল ছিল। পরবর্তীতে ব্যাঙ্গ করার প্রয়াস আসে। যদিও ব্যাঙ্গ রম্য করবার অভিপ্রায়কে আরো মারাত্মক করে তোলে। তো, সকুমার তার রচনায় প্রফেসর হুঁশিয়ারের গল্পকে সেই মারাত্মক ব্যাঙ্গ করেছেন। যেখানে আমরা ছোটরা আনন্দ পাই, আর সভ্যতার সুবজগ্রাসী, জলগ্রাসী, স্থলগ্রাসী, বায়ুগ্রাসীরা স্তব্ধ হয়ে থাকে। ছোটবেলায় পড়া হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’র কথা বটতলা নতুন করে মনে করিয়ে দিলো। মনে পড়ে গেল, ছক্কড় আর লক্কড় সিং, হ্যাংলাথেরিয়াম, ল্যাংড়াথেরিয়াম, বেচারাথেরিয়াম, চিল্লানোসরাস, গপ্পোথেরিয়াম, বেচারাথেরিয়াম, গোমড়াথেরিয়ামসহ আরো কতো নাম।

নিজ নিজ স্বভাবের বনের এই সব নাম পাওয়া পশুপাখি কিংবা তাদের ঘর কিংবা পৃথিবী কিংবা তাদের পরিচয়ই আসলে বটতলার এই বন্যথেরিয়াম।

*** দ্বান্দ্বিক মধ্যবিত্তের ঘরে মার্ক্স, পড়তে ক্লিক করুন এখানে। ***

নাটক শেষে শিশুরা আনন্দে নাচচ্ছে বন্যথেরিয়াম কুশীলবদের সাথে।

তো এই পৃথিবীর মালিকরা, জিগাই তোমরা কোন থেরিয়াম? চাইলে বটতলার বন্যথেরিয়ামে নাট্যকার নির্দেশক প্রাসঙ্গিকভাবেই এই প্রশ্নটা নিয়ে আসতে পারতো, সকুমার ওই অর্থে না আনলেও স্পর্শ কিন্তু ঠিকই দিয়ে গেছেন। সেই অর্থে বটতলা জেনে কিংবা না জেনে মালিকরা কোন থেরিয়াম এই প্রশ্নের স্পর্শ দিয়ে গেছে মনে মনে। যদিও এইটা মূর্তমান কোনো প্রশ্ন ছিল না, তবুও দেশেতো এখন কুকুরের মালিক, গরুর মালিক, বাজিগার, ময়না-টিয়া, বাঁদর, হনুমান কতো কিছুরই না মালিক আছে, তাই না? নয়া দাসত্ববাদ করপোরেশন আগ্রাসন এখন আমাদের নতুন যুদ্ধ, আর সে কারণেই বন্যথেরিয়াম রূপকার্থে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে মানুষের কাছে।

এই যে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এইটার সাথে সরকার কতোটা সম্পর্কিত কিংবা সুন্দরবন দখল করে পার্ক কিংবা উন্নয়ন- সরকার কতোটা সম্পর্কিত? সরকার কার সাথে সম্পর্কিত? এই যে কোভিড ফাঁদে কোটি কোটি মানুষ ভুক্তভোগী, কারা লাভবান?

আমি বোকার নিয়মিত লেখক। বোকার বোকা বোকা প্রশ্ন করাই আমার কাজ, প্রাসঙ্গিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক, তাতে কী? যারা ইজমগিরি কইরা কইবেন, আপনে ওই পর্যন্ত পইড়া আইসা কথা কন তারা সেলাম লন! কারণ আপনি এই পর্যন্ত পইড়া ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেননি, তাই বন্যথেরিয়াম প্রাসঙ্গিক।

নাটকে সুকুমার দারুণভাবে উপস্থিত

একটা নাটকে কলাকুশলীদের কতোটা নৈকট্য থাকলে এতোটা সুকুরমারবৃত্তি দেখা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বটতলা। এর আগেও বটতলার অন্যান্য প্রযোজনাগুলো এই ব্যাপারটি লক্ষ্যণীয়।

বন্যথেরিয়াম শিশুতোষ বলে প্রচার করা হলেও এইটা আসলে বুড়োদের জন্য যথার্থ। তাই, জয়তু বটতলা। বটতলা যেন এমন করেই প্রশান্তির স্নিগ্ধ সুবাতাসে আমাদের এবং আমাদের শিশুদের মন-প্রাণ জুড়িয়ে রাখে, এই শুভ কামনা রইলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top