বস্তুত প্রেম এক অন্ধ বিকেল
তার ছাদ বেয়ে উঠে যায়
নক্ষত্রের মুখ
সইতে হয়, সইতে না পারার বিমূর্ত যন্ত্রণা —-
আসমা চৌধুরীর কবিতা এরকম যেন, যেন বহুদূর থেকে প্রবাহিত নাম না জানা ঢেউয়ের কল্লোল… সুমধুর সুন্দর তার ধ্বনি। তার মুখে স্মিত হাসি। শেষ বিকেলের দীঘল চুল আলোর বন্যায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কোনো সবুজ চা- বাগানের মুখের ওপর। মানে তুমি চোখ ফেরাতে পারবেনা। কিন্তু সে নিজেই ফিরিয়ে নেবে মুখ।
আসমা চৌধুরীর কবিতা একটি লাল পিঁপড়ের পদযাত্রা দিয়ে শুরু হয়, তারপর তার হেঁটে যাওয়া পথে জন্ম নেয় ধ্যানমগ্ন সবুজ জ্ঞানী বৃক্ষের সারি; যেন অনন্তকাল তারা এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তারপর? সেই পথ চলে যায় সাগর মহাসাগরের দিকে… আকাশ পেরিয়ে অন্য কোনো আকাশের আয়নায় মুখোমুখি বসে। অতঃপর বলে-
‘শরীর ঢেকে রাখা চাবুকের দাগ
রাত্রিকে ঘুমাতে বলে ক্ষত পরিষ্কার করে…’
তারপর সেই পথে জড়ো হয় প্রেম।
‘বস্তুত প্রেম এক অন্ধ বিকেল
তার ছাদ বেয়ে উঠে যায় নক্ষত্রের মুখ —
সইতে হয়, সইতে না পারার বিমূর্ত যন্ত্রণা।’
কী তাঁর পরিচয়? কতটুকুই বা জানি পরিচয়? কবিবন্ধু সাবেরা তাবাসসুমের মাধ্যমে তাঁকে জানতে পারি ছ’বছর আগে। তারপর থেকে জেনেই চলেছি। যতটুকু দেখি তিনি স্মিত, পরিমিত, মার্জিত সুন্দর। তিনি কাব্যিক, অনুসন্ধিৎসু, লড়াকু সরল! দূর্গার দশহাতে সংসার, কর্মস্থান ও বেদনা সামলে নিমজ্জিত হন নিবিড় গবেষণা কাজে। কুসুম কুমারী দেবী, কামিনী রায় এবং লাবন্য দাস ত্রয়ীকে নতুন ডিসকোর্স নিয়ে শীঘ্রই হাজির করবেন তিনি। সহযোদ্ধা বন্ধু স্বামীকে হারালেও নিয়ত তার সঙ্গে অদৃশ্য প্রেমে মেতে থাকেন আর ডুবে থাকেন কবি ও কবিতায়।
এবারের বোকা তাই আপনাদের কাছে উপস্থাপন করছে এসময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সমাজচিন্তক ও অধ্যাপক আসমা চৌধুরীর কবিতা। যিনি আড়ালে আবঢালে লিখে চলেছেন অজস্র শব্দমালার গুঞ্জরন। পাখির পালকের মতো যার শব্দরা ঝরে পড়ছে আমাদের চারিপাশে। যার শব্দে সৌরভে নিভৃত রঞ্জন।
-সাকিরা পারভীন
চাঁদ উঠবে
যে অন্ধকার দ্রুত আসে,তার বুকেও চাঁদ জাগে
আমাদের পায়ে তখন শেকল জড়ানো রাত
ভয় পেয়ে কখনো প্রশ্ন করতেই ভুলে যাই
আসলে দেয়ালের ঘর কী করে বুঝবে চৌকাঠ?
সকাল ছুঁয়ে দেখবো বলে ঘুমহীন রাত,
কখন পালিয়ে যাবে সূর্যের ঐশ্বর্য ভরা উদয়
সব ভাবনার বিরতি হয় না,তবু বীজ বোনা মানুষ
শস্য দেখতে চায়,কখনো সবুজ পাতার মুখ।
আসো না,গোল টেবিল সাজিয়ে নিজেদেরকে দেখি
এই যে অভিনয় করা দিন,এই যে মুখোশ লাগাই নিজে
দুনিয়াশুদ্ধ লোকজন দেখে পাতলা হাসির ফোটা খই
এসবও কম নয় কিছু,এসব রক্তপাতের কোন সংখ্যা নেই।
আসো,দরজা খুলবো,বিশ্বাস করো চাঁদ উঠলে ছাদে
কেমন দ্রুত বদলে যাবে আমাদের অচ্ছুৎ জীবন…

শরীর
শরীর ঢেকে রাখা চাবুকের দাগ
রাত্রিকে ঘুমাতে বলে ক্ষত পরিষ্কার করে
কালসে রক্তের দাগ জিহবাকে কথা বলায়
বিনয় কী রূপকথার গল্প,পানতার সংসারে?
শরীর বাঁকা করে দ্বিতীয়বার প্রস্তুতি
পথ পার হয় সাপের খোলসে
অভিমান নামের সাদা খাতায় লেখা হয়
আঙুল ধরে যতই এগিয়ে যাও
সামনের প্রান্তরে কোন বিশ্রাম নেই…

আমার জন্য অপেক্ষা করে কেউ
বৃষ্টির নাম জানি,জলের খেলা
সাদা মেঘ,কালো মেঘ ডাকে
আমার জন্য অপেক্ষা করে কেউ।
ভুল হতে পারে ঠিকানা
জেগে থাকে শহর
জেগে থাকে চোখ
কার খোঁজ করে যাও রোজ?
পায়ে চলা পথ ধরে
সব হিসেব রেখে দিয়ে
একটি মধুর চুম্বন
সব দেনা ঋণ হয়ে থাক
পৃথিবীর ধুলো গুলো হৃদয়ে লেগেছে।
সাদা মেঘ,কালো মেঘ যতদূর যাও
একটি গোপন খবর নিয়ে যেও সাথে
ঘাড়ের ওপর থাক সমাজের ঠাঁই
হাতের আদল জানি লিখে যাব ফের।
আমিও নিঃশ্বাস নেই,জপে-তপে থাকি
আগুন লাগিয়ে দেই সংসার ভিতে
পরোপকারী রাধা হই,বিশ্বাসে জানি
কেউ একজন অপেক্ষায় দিন গোনে।
লাগুক বর্ষা,ভিজে শরীর শুকাতে দেব
ঘণ্টাধ্বনি বেজে যাক অবিরাম জল
ফেলে যাব দিনগুলো প্রভাতের নাম
একটি গভীর ডাকে দরজায় করাঘাত….
প্রেম
বস্তুতঃ প্রেম এক অন্ধ বিকেল
তার ছাদ বেয়ে উঠে যায় নক্ষত্রের মুখ
সইতে হয়, সইতে না পারার বিমূর্ত যন্ত্রণা
পাখিদের ঘোর ওড়ানোর পাখা,ফিরবার শ্লথ রেখা
কতদিন আকাশে রেখেছে মুখ দিন শেষের গান
প্রেম,সেই এক কাকাতুয়া,বন্ধ খাঁচায় দিনমান।
প্রেম এক পালিয়ে যাওয়া শরীরের স্বাদ,
খুব খুঁজে নেয়া নোনা
যে রক্তপাতের ঠিকানা কোনদিন হারায় না।

ফের
কিছু
একটা
হবে
যে কোন বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে দিলে মনে হয় নিরাপদ
আবার খুলবো
বিছানার চাদর উল্টে দিয়ে ময়লা লুকাই
উল্টো জামা পরে কোন কোন মুখের প্রশ্ন হয়ে থাকি
কেউ বলে না তুমি সংশোধন হও।
উল্টে পাল্টে নিজেকে দেখেছি
নিবেদন করেছি জ্যোৎস্নায়
ঘোর শ্রাবণে গীতবিতানের পাতায়,বৈশাখের মেলায়
এত উল্টো খেলা চলছে,কেন অমল পৃষ্ঠার মতো যত্ন করে
এখন আর রাখতে পারিনা স্বজনের মুখ
অবাক হয়ে ভাবি,কেন যুদ্ধে যাওয়া মানুষেরা
আজ উল্টে ফেলে নিজেকে
এই প্রহরে খোঁজ নিয়ে জানলাম বদলে যাওয়া জীবনের হিসেব নিয়ে
ফের কিছু হবে…
একটা কোমল বিষণ্ন নীল অপরাজিতা
চুপ করে বসে আছি,ভালোবাসা!
আমার গালে মাটির রোদ্দুর
স্পর্শ পাই পাখির পালক
নরম মেঘের জামা ভেসে আছি।
ভালোবাসা শব্দটি অনেকেই এড়িয়ে যায়
ডাকাতের মতো,তার শরীরে নামে ক্ষয়।
অনেকেই লুকিয়ে রাখা চিঠি,ডায়েরি খুলে
একটু স্পর্শ রেখে আবার বন্ধ করে
যেন কতদূর থেকে হেঁটে আসে ভয়
মচকানো ডানা ফুলে ওঠে,সাড়া পড়ে যায়
নষ্ট লোকের তালিকা তার অক্ষর মেলে ধরে।
ভালোবাসা শব্দটি পেয়ে আমিও ভেবেছি
সেই কবে থেকে উনুন জ্বালাতে পারি
ভালোবাসা ভেজে নেয় বুকের কড়াই…
নিজের ঢোল নিজে পেটানোর দিন শ্যাষ, কইলাম কিন্তু শেখ মুজিবের বাংলাদেশ!
চ্যানেল খুইলাছি ট্যাকা কামাইছি, হাইঞ্জার সম বিড়ি ধরাইছি, ঘরে আমার রূপবতী নারী; ভূতে কিলাইছে, আমি হালার-পো-হালা বিরাট সুখী!
ভালোবাসা নীল অপরাজিতা মাটির রোদ্দুর
পাখির পালক মেঘের জামা
দ্বন্দ্ব
সেইভাবে আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি
খোলা ছাদ,পাতাঝরা দিন,রাতের শিশির
পাশাপাশি দাঁড়ালে টের পাই সবুজ বৃক্ষগুলি
মানুষের ভীড় দূরে সরে যায়,আমি আর তুমি।
কোন ভাঙাই কোনদিন জোড়া লাগে না
তবু কাতরতা,দূর থেকে শুনে যাই বর্তমান সংবাদ
পাতার কাছে,শাখার কাছে মেঘ বেঁধে রাখি
পেছনে দাঁড়াই, আস্তে হাঁট, যেন এই মুখ
লুকিয়ে থাকুক সুখীর দরজা থেকে।
শীত নামলে তোমার কষ্ট হতো খুব
শীত এসেছে,কদিন টুপি-মাফলারে জড়িয়েছি খুব
হিসেব করে দেখি কত বয়স পার করেছ,কত পাখি ডাকে রোজ।
দ্বন্দ্ব শুধু কথায় নয়,মনে হয়, শরীরে হয়, ক্ষমতায় হয়
দ্বন্দ্ব আছে বলেই তোমাকে এত মনে পড়ে!
দাহকাল
জল কি সব ধুয়ে দিতে পারে?
পৃথিবীর কাজল পরা চোখ ঢেকে যায়
চিঠির মত খুলে পড়া যায় কী দাহকাল?
আমাদের গানগুলি কেন যে খুঁজে পাই না
হাঁটু ভেঙে বসে থাকে সারারাত
আকাশের অন্ধকার খেলা করে তারাদের সাথে
একা দোলনায় লেগে থাকে সময়ের খড়
মন থেকে ঝরে পড়া আহারের দরবারে যোগ হয়
প্রয়োজন খুদ,সেখানে আয়োজন মিথ্যা বোনে মুখোশ
ফাঁদে আটকা স্বপ্ন, থাক্কা খায় কাছে,দূরে।
কার কাছে বাঁশি থাকে তুমি তার ফুঁ হবে সুরে!
কবির চরিত্র
একজন কবির চরিত্র লিখতে লিখতে
আমরা তাকে বাঁকা করি,কালো করি
তার অমর চোখ নিয়ে হাতের আঙুলে ঝলসাই
কবি তার জামার পকেট ভরে যে নামে রাখেন মুদ্রা
তার এক ডাকনাম আছে জলবিষন্নতা।
রাত পাহারার হিসেব লিখে,কখন যে নিজেই মৃত হয়ে যাই
গান গাই,পাথরের কাছে ধার করি হিম,নদীর কাছে বালু
ইচ্ছে করে অভিমানের ঝুলিটা লুকাই,দুঃখ থেকে ছায়ামৌনতা।
কবির পাশে বসতে কারো কারো চুল ওড়ে,হাসি নিভে যায়
কবি কারো দেরাজ হয় না,শরিক হয় না বোনাসের
বাতাস ঝড় হলে কবি এক একলা আকাশ
তার দুঃখ কেউ বোঝে না,তার সুখ কেউ বোঝে না.….
হয়তো মনে নেই
খাদে দাঁড়িয়ে আছি, চিনতে কী পারো?
পাহাড়ের ওপারে বাড়িগুলি,রোজ মোরগ ডাকে
সূর্য নামায় পথ,হেঁটে যেতে আঁধারের বাঁক
চোখ থেকে মৃত্যুর গন্ধ সরিয়ে হাতগুলো ভরে আনারসে।
চিনতে কী পারো ছাতুর মতো মেখে নিয়েছি তোমার হৃদপিণ্ড!
আমাদের স্কুলে পাঠ হতো শিকারের গন্ধ
কী করে লাভ করা যায় শীতের ভেড়ার পশম
কাপর বোনার তাঁত হয়ে তোমার পাশেই
রোজ বুনেছি স্বাদ।
বৃষ্টি নামলে ঢেউ ওঠা জলে একটা শরীর হয়েছি গানে
চোখ বুজে টেনেছি ওষুধের মতো নিরাময় তোমার চোখে।
এই জন্মে কাছে এসে চাবুকের ক্ষত বলেছে অসামাজিক
দূরে যাই,সমতল উঁচু বাড়ির ভেতরে হাহাকার লেখে
ধোঁয়ার ভেতরে যারা বসে থাকে তারা হলেন ঈর্ষার পুঁজ।
পাহাড়ের মাথায় কারা যেন বসতির বাণিজ্য ছড়াচ্ছে
তুমি আমি কেউ নেই সেখানে।
জন্ম : ৩০.১১.১৯৬৫
মেহেন্দিগঞ্জ, বরিশাল।
পেশা: অধ্যাপনা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সহকারী অধ্যাপক।
বেগম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজ,বরিশাল।
সাহিত্য কর্ম: কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও শিশুতোষ সাহিত্যে বিচরণ।
বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার।
প্রকাশিত গ্রন্থ: ১৬।
প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ: বসবাস (গল্পগ্রন্থ) ১৯৯০।
প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: আকাশী রঙের মেয়ে ২০০২।
প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ: কবিতার বরিশাল ২০১৩।
প্রথম প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থ: পিশু বেড়াল ও লাল মোরগ ১৯৯৬।
এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ, আলো-আঁধারে জীবনানন্দ, সুফিয়া কামালের জীবনী, আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনী।
পুরস্কার: সুনীতি পুরস্কার ২০০০।
জয়িতা ২০১৩। জাতীয় কবিতা পরিষদ, বরিশাল থেকে সম্মাননা ২০১৬। বরিশাল জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক ২০১৬।
বরিশাল জেলা প্রশাসন থেকে জীবনানন্দ পদক ২০১৭।

Pingback: সিঙ্গেল মাদার