বোকা বনাম স্মার্ট, বোকা মনে করছে বাংলার সমাজে এক অদ্ভুত যুদ্ধ চলছে।
এটা রাজনীতি নয়, ধর্ম নয়, এমনকি টাকার লড়াইও নয়।
এটা হচ্ছে এক নিঃশব্দ, নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ — বোকা বনাম স্মার্টদের মধ্যে।
এই যুদ্ধে কোনো ঘোষণা নেই, কোনো পতাকা নেই, কোনো লড়াইয়ের মিছিল নেই।
তবুও সবাই এই যুদ্ধে জড়িয়ে আছে।
কেউ হয়তো ভিডিও বানাচ্ছে, কেউ চুপচাপ ভাবছে, কেউ অনলাইনে রিয়্যাকশন নিচ্ছে।
কিন্তু ভেতরে এক প্রশ্ন ঘুরছে—
“এই সমাজে আসলে কারা জিতছে?”
স্মার্টদের উত্থান: ক্যামেরার আলোয় জীবনের প্রতিযোগিতা
স্মার্টরা এখন সর্বত্র।
তাদের চুলে জেল, চোখে ফিল্টার, কথায় কোটেশন।
তারা জানে কোন ক্যাফেতে আলো সবচেয়ে ভালো পড়ে, কোন ফ্রেমে হাসলে ইনস্টাগ্রাম ভাইরাল হয়।
তাদের কাছে জীবন মানে ভিউ, রিচ আর রিঅ্যাকশন।
প্রতিদিন তারা গণনা করে—আজ কত লাইক, কত কমেন্ট, কত শেয়ার।
যদি কোনো দিন কম হয়, তারা উদ্বিগ্ন হয়; মনে করে, আজ “জনপ্রিয়তার ব্যালেন্স শীট” ঠিক নেই।
তাদের পৃথিবীতে একমাত্র মন্ত্র — দেখাতে হবে, তাহলেই বাঁচা যাবে।
এরা এমনভাবে বেঁচে থাকে যেন প্রতিটি মুহূর্ত এক রিল।
বাস্তব জীবন কেবল রিলের ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড।
আর এই ব্যাকগ্রাউন্ডকে যত সুন্দর দেখাবে, তত বেশি মনে হবে—জীবন সফল।
জন্ম থেকেই স্মার্ট হওয়ার প্রতিযোগিতা
একটা সময় ছিল, যখন মা-বাবারা ভাবতেন—“সন্তানটা ভালো মানুষ হোক।”
এখন চিন্তা একটাই—“স্মার্ট হোক।”
শিশুর হাতে এখন খেলনা নয়, স্মার্টফোন।
সে “মা” বলার আগেই শিখে ফেলে—“Hey Google!” “হোয়াজাপ?”
তার প্রথম হাঁটা ফেসবুক লাইভ,
প্রথম কান্নার নিচে মায়ের কমেন্ট—“My strong baby boy 💪❤️।”
এভাবে বড় হতে হতে আমরা সবাই শিখে গেছি—
দেখানোর আগে বাঁচার মানে কিছুই নয়।
আমরা হয়ে গেছি ‘ডিজিটাল প্রজন্মের মানুষ’, যাদের চিন্তা, আনন্দ, এমনকি কান্নাও এখন কন্টেন্টের উপাদান।
এরা ছোটবেলা থেকেই শিখছে, অনুভূতি ব্যক্ত করার মানদণ্ড হলো কীভাবে সেটা ভাইরাল হবে।
একটা হাসি, একটা কান্না—সবকিছু গণনা করা হয়।
এমনিতে কি আমরা সুখী, সেটা কম্পিউটার জানে না, মানুষও জানে না।
ফিল্টার ছাড়া চিন্তা চলে না
আমরা যা ভাবি, তার আগে ভাবি—“এটা পোস্ট দিলে কেমন যাবে?”
বুদ্ধি যেন সেলফি ক্যামেরার মতো—ফিল্টার ছাড়া চলে না।
আমাদের মনের আলো আর ছায়া এখন নির্ভর করছে অ্যালগরিদমের মুডে।
আমরা নিজের সম্পর্কে জানি কম,
কিন্তু নিজের প্রোফাইল অ্যানালিটিক্স সম্পর্কে জানি বেশি।
দিনের শেষে প্রশ্ন থাকে—“কে লাইক দিল, কে দিল না?”
জীবনের মান আজ মাপা হচ্ছে নোটিফিকেশনের সংখ্যায়।
ফিল্টার ছাড়া কেউ শ্বাস নিতে পারে না।
যদি ছবি ঠিক না আসে, ফ্রেমটা ভুল হয়, আলো কম হয়—স্মার্টদের দিন অন্ধকার।
তাদের আনন্দও আজ স্ক্রিনের পিক্সেলে রূপান্তরিত।
বোকাদের সহজ জীবন: শান্তি এখনো সত্যি
অন্যদিকে বোকারা আছে। তারা খুব সহজ, নির্ভেজাল, সরল।
তারা জানে না AI কী, কিন্তু বিশ্বাস করে—“একদিন সব বোকাদের হবে।”
তাদের ইনবক্সে কেউ “seen” দিয়ে ঘুম ভাঙায় না।
তাদের ঘুম ভাঙে মোরগের ডাক, শিশুর হাসি, বা খাওয়ার সময়কার স্বাদে।
তারা জানে—সব কিছু না জানাও এক ধরনের মুক্তি।
তাদের মাথায় ফলোয়ার বাড়ানোর চিন্তা নেই, চিন্তা আছে শুধু চালের দাম, শিশুদের স্কুল ফি, এক প্লেট ভাতের স্বাদ।
তারা এখনো “ধন্যবাদ” বলে, “ভাই” ডাকে মায়ায়, বদলে কিছু পাওয়ার আশায় নয়।
তাদের মুখে আছে পরিতৃপ্তি—যা কোনো ফিল্টারে ধরা যায় না।
বোকারা জানে, সুখ মানে নতুন ফোন নয়।
সুখ মানে দুপুরে এক প্লেট ভাত, পাশে হাসিমুখের পরিবার।
এই সরলতার মধ্যেই আছে বিস্ময়কর শান্তি।
স্মার্টদের ভয়: আনস্মার্ট হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক
স্মার্টদের জীবন এখন ভয় আর প্রতিযোগিতায় ভরা।
তারা ভয় পায়—আনস্মার্ট হয়ে গেলে সমাজের চোখে মর্যাদা হারাবে।
তারা ভয় পায় একদিন কেউ বলবে—“এই ছেলেটা এখন আর ট্রেন্ডে নেই!”
তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ক্যামেরার সামনে না হলে তারা বাঁচতে পারে না।
ঘুরতে যায় ছবি তোলার জন্য, কফি খায় স্টোরিতে দেওয়ার জন্য।
বাস্তবতার আনন্দ হারিয়ে গেছে ভার্চুয়াল আলোয়।
এমন এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা নিজের চোখে চোখ রাখতে পারে না,
কিন্তু ক্যামেরার লেন্সে তাকিয়ে কাঁদতে পারে অনর্গল।
তাদের জীবনের আনন্দ পরিমাপ হচ্ছে লাইকের সংখ্যা দিয়ে।
ভুল করা এখন কনটেন্ট, মানুষ নয়
এই যুগে ভুল করাও অপরাধ।
একটা ভুল শব্দ, এক ভুল পোস্ট—হয়ে যায় ভাইরাল কনটেন্ট।
“Look what he said!” — বলে সবাই হাসে,
কিন্তু কেউ ভাবে না, ভুল করা শেখার অংশ, ট্রেন্ড নয়।
আমরা এখন এমন সমাজে বাস করছি যেখানে ক্ষমা নেই,
শুধু স্ক্রিনশট আছে।
যেখানে ভুল মানুষকে নয়, মিমকে জন্ম দেয়।
এইভাবে, মানুষ ভুলে যায়—মানুষ হওয়া মানে কখনও ভেঙে পড়া, কখনও লাফানো।
বোকার সৌন্দর্য: সরলতাই শক্তি
বোকারা নিজেদের বোঝাতে চায় না।
তারা জানে—পৃথিবী তুচ্ছ, সময় ক্ষণস্থায়ী।
বুদ্ধিমানরা হাসে অন্যের ভুলে,
বোকারা হাসে নিজের ভুলে।
তাদের সরলতা এক অদ্ভুত শক্তি।
তারা জানে না SEO কী, কিন্তু জানে সত্য বললে শান্তি পাওয়া যায়।
তারা জানে না ChatGPT কীভাবে কাজ করে,
কিন্তু জানে মানুষকেই সবচেয়ে বড় শিক্ষক।
বোকারাই দেশটাকে টিকিয়ে রেখেছে।
তারা এখনো মাঠে কাজ করে,
ট্রেনের ছাদে বসে বাড়ি ফেরে উৎসবে।
তারা বিশ্বাস করে—ভালো কিছু করলে একদিন ফল পাবেই।
স্মার্টদের জয়, না বোকার?
দেখলে মনে হয় স্মার্টরাই জিতছে।
তারা আলোয় আছে, নাম আছে, ব্র্যান্ড আছে।
কিন্তু এক মুহূর্ত থামো—
যে মানুষ সারাক্ষণ প্রমাণ দিতে ব্যস্ত যে সে সুখী, সে কি সত্যিই সুখী?
বোকারা হয়তো আলোয় নেই, তাদের ছবি ভাইরাল হয় না,
কিন্তু তাদের মুখে থাকে একরাশ শান্তি।
তারা জানে—জীবন মানে প্রতিদিন নতুন পোস্ট নয়,
জীবন মানে প্রতিদিন একটু করে ভালো থাকা।
সমাজ বদলায় স্মার্টরা, টিকিয়ে রাখে বোকারা
স্মার্টরা সমাজ বদলাতে চায়, বোকারা সমাজ বাঁচাতে চায়।
একজন আলো খোঁজে, অন্যজন মানুষ খোঁজে।
একজন পরিবর্তনের কথা বলে, অন্যজন টিকিয়ে রাখার কথা ভাবে।
দুই দিকই জরুরি।
যেখানে শুধু স্মার্টরা থাকে, সেখানে মানবতা হারিয়ে যায়।
আর যেখানে বোকারা নেই, সেখানে ভালোবাসা টেকে না।
এক নেটওয়ার্কে দুই পৃথিবী
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো—বোকা আর স্মার্ট দুজনেই একই নেটওয়ার্কে কানেক্টেড।
তফাৎ শুধু মনোভাবের—একজন হাসে নিজের ভুলে, অন্যজন হাসে অন্যের ভুলে।
একই পোস্ট দেখে একজন বলে, “মজার!”
অন্যজন বলে, “এইটা ভাইরাল হবে।”
একজন লাইক দেয় ভালোবাসায়, অন্যজন দেয় অ্যালগরিদমে।
এই দুই পৃথিবী পাশাপাশি বেঁচে আছে।
কেউ কারও জায়গা পুরোপুরি নিতে পারে না।
কারণ, যে সমাজে বোকা নেই, সেখানে মায়াও থাকে না।
তার জন্ম হয়
কাঁটা দিয়ে—
যাতে সে ফুল হয়ে উঠতে না পারে সহজে।তবু সেই কাঁটা দিয়েই
সে নিজেকে তীক্ষ্ণ করে তোলে,
একদিন কবিতায় লিখে ফেলে নিজের শরীরের মানচিত্র—
বোকা বনাম স্মার্ট: সত্যিকারের জয় কার?
এই যুদ্ধে আসলে জয়ী কেউ নয়।
স্মার্টরা হয়তো শিরোনামে, কিন্তু বোকারা আছে হৃদয়ে।
দেশটা এখনো টিকে আছে,
কারণ বোকারা এখনো মানুষ হয়ে থাকতে জানে।
তারা জানে—সেলফি নয়, “ধন্যবাদ” বড় কথা।
ভিউ নয়, “দৃষ্টি”ই আসল।
বুদ্ধি নয়, মায়াই জীবনের চালিকা শক্তি।
বোকা বনাম স্মার্ট: বোকা’র চ্যালেঞ্জ 🎯
তাহলে big bro-দের দেশে, তুমি কী মনে করো—বোকারা হারছে, না স্মার্টরা?
কমেন্টে জানাও তোমার মতামত 👇
বোকাবিডিতে এই আলোচনা চলবে চিরকাল,
কারণ এখানে “বোকা” মানে মূর্খ নয়—
এখানে বোকা মানে মানুষ,
যে এখনো মন দিয়ে দেখে, ভালোবাসা দিয়ে বোঝে, আর সত্য বলতেও ভয় পায় না।
শেষ কথা
হয়তো একদিন আমরা সবাই বুঝব—
স্মার্ট হওয়া নয়, মানুষ হওয়াই আসল জয়।
যে সমাজে সরলতা টিকে থাকে, সেই সমাজেই এখনো হাসি টিকে থাকে।
তাই যতই স্মার্টফোনে আলো জ্বলে,
এই দেশটা টিকে থাকবে যতদিন—
বোকারা মন দিয়ে ভালোবাসতে জানে। ❤️