দুর্ভিক্ষের দেশে প্রাণ শিশুরা- জন্মে মরে

মানুষ হয়েও এই ছবিগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত দেখতে হচ্ছে। ১৯৯২ সালে সোমালিয়ায় মানব সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে এভাবেই কঙ্কালসার মানুষ পড়ে থাকতো পথে ঘাটে। এই লজ্জা পুরো পৃথিবীর মানুষকে বয়ে বেড়াতে হবে। সেসময়কার দুর্ভিক্ষের এই ছবিটি তুলেন বিখ্যাত আলোকচিত্রী জেমস নাৎসভি।

দুর্ভিক্ষের দেশে; ১৯৯১ সালের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক দুর্যোগ সহায়তা কার্যালয়ের প্রাক্তন পরিচালক অ্যান্ড্রু নাটেসিয়াস একবার এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, পৃথিবীর সব থেকে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটছে এখন। রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি বিশ্বব্যাপী দুর্গত মানুষের সহায়তার জন্য যে বাজেট করেছে তার ২০ শতাংশ কেবল সোমালিয়ায় ত্রাণ সহায়তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হচ্ছে সোমালিয়ার মানুষ কতোটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও সোমালিয়ার সংকটের প্রকৃত মাত্রা বরাবরই গোপন ছিল। কারণ দেশটিতে যে গৃহযুদ্ধ চলছে তাতে ক্রমাগত হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যা আমাদের ধারণার বাইরে। একই সাথে ভয়াবহ খাদ্যসংকটে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এই সংকটকে আরো ভয়াবহ আকার দিচ্ছে।

উত্তরাঞ্চলের যারা সোমালিল্যান্ড গঠন করেছিল তারাসহ পুরো সোমালিয়ানরা এখন হতাশায় ডুবে আছে। যদিও নভেম্বরের মাঝামাঝি যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয় তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মোগাদিসু। একটা পরিসংখ্যান থেকে আমরা ধারণা করছি, কেবল মোগাদিসুতেই ১৭ নভেম্বর থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রায় ১৪,০০০ মানুষ নিহত আর ২৭,০০০ মানুষ আহত হয়। এই তথ্য কেবল নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতাল আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া। বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ।

আধুনিক সব যুদ্ধাস্ত্র নির্বিচারে মানুষের উপর ব্যবহার করে যে মানবিক সংকট তৈরি করা হয়েছে তা এরই মধ্যে মোগাদিসুকে পৃথিবীতে একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। যা লজ্জার হতাশার এবং বর্বরতার। অমানবিক নিষ্ঠুরতায় সব কিছুকে টপকে গেছে মোগাদিসুর গৃহযোদ্ধারা। যেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সাধারণ মানুষ মারার নেশায় মত্ত সশস্ত্রীরা।

যুদ্ধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অন্যতম বিষয়ই হলো, যুদ্ধের সময় সাধারণ নাগরিককে প্রতিপক্ষ না করা। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাধারণ নাগরিককে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আহত হলে তাদের পরিচর্যা চিকিৎসা নিশ্চিত করা। যুদ্ধের সময় চিকিৎসা সেবায় বিঘ্ন না ঘাটানো। ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলোর সুরক্ষা মেনে যুদ্ধটা ক্ষতির সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনে। কিন্তু আমরা দেখছি সোমালিয়ায় তার উল্টোটাই ঘটছে। আর এই প্রতিবেদন থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সামনের দিনগুলো দেশটির জন্য ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনছে। দেশটির সব মানুষকে এর মূল্য দিতে হবে।

এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করে, আফ্রিকা ওয়াচ অ্যান্ড ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠন। যাদের সাহায্যে সোমালিয়ায় থাকা দুটি মানবিক সহায়তার মিশন পরিচালকদের অনুসন্ধান এবং তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি। এই মিশন দুটির কেন্দ্র ছিল মোগাদিসু। যদিও পাশের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

২০১১ সালের এক প্রতিবেদনে ডয়চে ভেলে উল্লেখ করে, পূর্ব আফ্রিকায় ক্ষরা এবং দুর্ভিক্ষের দিকে এখন বিশ্বের সবার নজর৷ গত কয়েক দশকে আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ বারবার বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে৷ তবে এ বছরের দুর্ভিক্ষ এবং খরা সবচেয়ে বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে৷

সে সময় জাতিসংঘ সতর্ক করে জানিয়েছিল, ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং সোমালিয়ায় যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে তা গত ৬০ বছরে দেখা যায়নি৷

আর সে সময় অর্থাৎ ২০১১-১২ সালের দুর্ভিক্ষে সোমালিয়ায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মারা যায়। যা এই সভ্য আধুনিক যুগের মানুষের দৃষ্টিগোচরই হয়নি। তাদের চিন্তা চেতনায় কোনো আঘাতই তৈরি করেনি।

অথচ দেশটিতে ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলো ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে। ভেঙে পড়েছে জন জীবন। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে সাধারণ মানুষেরা হতাশ হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে শরণার্থী শিবির কিংবা অন্য কোনো দেশে। বিবিসি ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের সে সময়কার মহাসচিবকে কোট করে উল্লেখ করে, জাতিসংঘের খাদ্য তহবিলের হিসাবে ২০১১ সালে সোমালিয়ায় না খেতে পেয়ে মারা গেছে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ যাদের অর্ধেকই শিশু।

২০০০ সাল থেকেই সোমালিয়ার সংকট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আর এখন ২০২১ সাল। এই লম্বা সময়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে দেশটির মানবিক পরিসর। কিন্তু কী করণে সোমালিয়ায় দশক দশক ধরে চলছে এই বিপর্যয়? এর পেছনে দুটি প্রধান কারণের একটি গৃহযুদ্ধ (ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলো মারাত্মক সব কর্মকাণ্ড)। আর দ্বিতীয়টি হলো খরা।

এবার এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার ২০২০ সালে প্রতিবেদনে সোমালিয়া সংক্রান্ত কী তথ্য সভ্য মানুষকে দিয়েছে।

সংস্থাটি স্পষ্টতই বলেছে, দেশটিতে চলমান সংঘাত, নিরাপত্তাহীনতা, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার অভাবের কারণে পুনরায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে বেসামরিক নাগরিকরা নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কেবল সোমালিয়ার ভিতরেই প্রায় ২৬ লাখ বাস্তচ্যুত মানুষ রয়েছে।

সরকার এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে আল শাবাব যে কাউকে ধরে নির্যাতন করেছ হত্যা করছে।

শিশুদেরকে কোনো কারণ ছাড়াই নানা ধরণের নিপীড়ন সহ্য করতে হচ্ছে দেশটিতে।

ক্ষুধার্ত মা-বাবার সামনে তার ক্ষুধার্ত শিশুটি না খেয়ে কঙ্কালসার হয়ে মারা যাচ্ছে! পৃথিবীতে এর চেয়ে ভয়াবহ অমানবিক দৃশ্য আর কি হতে পারে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top