ঠান্ডা ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প

Table of Contents

তাহসিন রিফাত নূর রুফতি

কে আমি?

সিনেমাপাড়ায় ফ্যাফ্যা করে ঘুরে বেড়ানোদেরই আরেকজন, মাথার মধ্যে কয়েকটা বিষ্ফোরক জমে আছে- কোনও না কোনওদিন ঝড় হবে।

কেন লিখি?

গলায় জমে যাওয়া শব্দগুচ্ছ যখন বুকের মধ্যে ঘরঘর করে, ফ্রিজে খাবার শেষ হয়ে যায় আর গেলাসে মদিরা- ,তখন গল্পের কাছে হাতজোড় করে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় তো মেলে না! অন্য দুনিয়ায় ডুব দিয়ে নিজের দুনিয়াটাকে যাচাই করে নেয়ার একটা অযুহাতও বটে।

ঠান্ডা ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প // তাহসিন রিফাত নূর রুফতি
ঠান্ডা ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প- লেখক: তাহসিন রিফাত নূর রুফতি
ঠান্ডা ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প

আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ হেবি গুলায়ে যায়, মাইরি! ফিজিক্সের প্রফেসর হইলে আপনি ভাবতেন আহা, কি আঁতেল কথা! সত্যিই তো, কোনটা অতীত আর কোনটা ভবিষ্যৎ সেইটা তো ডিপেন্ড করছে আপনি গ্যালাক্সির কোন কোনা থেকে অবজার্ভ করতেসেন তার ওপর। প্যারা নাই! 

আমার কোনও কিছুতেই প্যারা থাকে না। 

এই যে আমি সারাটা জীবন ডাউন প্লে করে চলতেছি, নিজেরে জমাইয়া রাখতেছি কোনও মোক্ষম মুহুর্তের অপেক্ষায়… আমি জানি না সেই মোক্ষম মুহুর্ত কবে কখন কোথায় উপস্থিত হবে! এইটা বুঝতে পারসি যে যাদের তর্কের ময়দানের ঠিকঠাক জবাব তিনদিন পরে মাথায় আসে তারা বড় হয়ে খুব ভালো ঝগড়ার সিন লেখতে পারে। আমি তো বাল কোনও রাইটার ও না যে এমনে নিজেরে সান্ত্বনা দিব, প্যাড়া নাই! আমার কোনকিছুতেই প্যাড়া থাকে না। 

বাসায় ইঁদুরের উৎপাত শুরু হইছে। আমিই দায়ী। প্রথম যখন একটা ধাড়ি বেটি জুলুজুলু চোখ কইরা আশ্রয় চাইল, আমি দয়াপরশ হোক আর যাই হোক, তাঁরে বললাম, থেকে যা… কেউ তো থাকে না ফাইনালি! 

সে থেকে গেল। শুধু থেকে গেল তাই না, কয়দিন পর একগাদা ছানাপোনা নিয়া হাজির হইল। মিষ্টি সব ইঁদুর। মাঝরাত্রে যখন গোলাপচারা কিইন্যা ফিরি, ওরা অপেক্ষা করে। অপেক্ষা আমার ভালো লাগে না, ওদের লাগে কি না কে জানে!  ওদের আমার ঠাকুমার ঝুলি শুনাইতে মন চায়, কিন্তু অপদার্থগুলা আমারে বুঝতে ব্যর্থ। হিজলতলায় পা ঝুলিয়ে বসা শাকচুন্নি বা পুরনো অন্ধকার ঘরে ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়ে আসা আলোয় বাতাসে ভাসতে থাকা ধুলোর একটু নিচে ট্রাংকে সুতি কাপড়ে মোড়ানো মায়ের ছোটবেলার ফোটো অথবা সার্কাসের দুখী ক্লাউনের ঈদের নতুন জামা- কোনওটার মত সত্যিকার ভালবাসারও দেখা পাইনি এ জন্মে। কিন্তু শুনেছি এসব আছে, কেউ কেউ পায়। পাশের বাড়ির মিজান মামার লটারি জেতার মতন। আল্লারে, চোখদুটা খুব পড়ছে মনে, এই কথাটা কেমনে বলি? ওদের বলি, ওরা শুনে। 

ছন্দাকে আপনারা চেনেন না, আমি যদি রাইটার হইতাম, ছন্দা কখনো মরত না। এবার চিনে নেন আরকি! যাইহোক, প্যাড়া নাই!

ঠান্ডা ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প

হেবি খিদা লাগসে বাল! আমার সারাদিন খিদা লাগে! আমি এত খারাপ কেন আমি জানি না, টিউশনিগুলাও ছুইটা যাইতেসে একের পর এক। 

রাস্তায় বের হইলাম। আমার হাঁটতে ভাল্লাগে। পকেটে হাত ঢুকায়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি হাইটা যাইতে পারি। হাঁটতে হাঁটতে আমি খেয়াল করিনি অথচ, খেয়াল  করিনি 

খেয়াল করিনি 

খেয়াল করিনি অথচ 

খেয়াল করিনি অথচ 

আর্মিটোলা চলে আসছি! আর্মিটোলা ছন্দাদের বাসা। আমার পেটভ্ররতি খিদা, গা ভর্তি ঘাম। 

সদর দরজার সামনে দাড়ানু। মাথা নিচু। 

ইতস্তত কলিংবেল এ হাত রাখনু। টিপ ও দিনু একটা। 

ঘুরে যাব যাব করছি এমন সময় ভেতর থেকে খ্যসখ্যাস পায়ের আওয়াজ পানু। কেউ আসছে নাকি! 

আজকে তো বিষ্যুদবার। বিকালও হয়ে গেছে প্রায়। ছন্দার কলেজ শেষ হয়ে কোচিং ক্লাস ও বোধয় শেষ। মেয়েটা হয়তো বাইরের ঘরেই আছে। ছন্দার আম্মু?  যাকে সম্বোধন করা সবসময় এড়িয়ে চলতে চাইতাম, সেই ভদ্রমহিলা? মনে মনেও মুখ থেকে ‘ম্যাডাম’ চলে আসত অথচ বুঝতাম ‘আংটি’ ডাকলেই সবদিক রক্ষা হয়? সেই আন্টীরূপী ম্যাডাম যদি দরজা খুলে? ছন্দাকে দেখতে আসছিলাম বলে পার পাওয়া যাবে তো ? 

ধুর বাল! একটু ভাতই তো খাবো, ভাত খাবে না মানুষ? 

সন্তর্পনে দরজায় টোকা দিনু। একটু বাদে খুট করে দরজা খুলে গেল। 

ছন্দা! 

ছন্দা দাঁড়িয়ে আছে। নিরাসক্ত নির্লিপ্ত দৃষ্টি। 

“আসেন।“ 

শুননু। মাথা নিচু। কি বলব ভেবে নিচ্ছিনু, তাকিয়ে দেখনু ছন্দা দরজা থেকে সরে গিয়ে সোফায় বসে মোবাইলে মনযোগী। 

অপরাধীর মত হেঁটে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসনু। চুপচাপ। 

হায়রে! কিছু তো বলো! কিছু তো বলো! 

আচ্ছা, চোখ তুলে তাকাতে সাহস হচ্ছে না কেন? ছন্দাই তো! পড়া করেনি বলে কতদিন ধুমসে মাইর ও দিসি! এই তো সেই মেয়েই!  কখনো তো একটুও বাধোবাধো ঠেকে নাই! 

ভাতই তো খাবো, আর কিছু না থাক একটু ডাল কি থাকবে না ফ্রিজে? আর তো পারি না! খিদা লাগসে রে বাবা! 

ডাইনিং টেবিলের বরাবর সামনে ভেতর ঘড়ের দরযা, দুই দরজায় ভারি নীল পর্দা। নিশ্চয় আন্টি আছে। 

ছন্দা ডানদিকে সোফায় বসে গেমসে ডুবে আছে। নীল পর্দার দিকে টুক করে তাকানু, আবার মাথাটা নিচু করে ফেলনু। 

ঠান্ডা ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প

থ্রি কোয়ার্টারের সাথে গেঞ্জি পড়েছে ছন্দা। এবার এইচ এস সি দেবে। ইশ! অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ব্যাকপ্যাকে ওকে কি দারুণ মানাবে! আরে! মেয়েটা চুলগুলো ছোট করে কেটেছে নাকি? তাই তো মনে হচ্ছে। নিশ্চিত হতে একবার তাকালাম ওর দিকে। এই সামান্য নড়াচড়াতে ছন্দা মাথা তুলে তাকাল। গেম খেলা থামিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। পর্দা ঠেলে অন্য ঘরে গেল। 

একটু আরাম করে বসনু এই  ফাঁকে। ঘরটা মাথা ঘুরিয়ে দেখতে লাগনু। 

পর্দা ঠেলে ম্যাডাম ঢুকল। তৎক্ষণাৎ পূর্ববত কাঠকাঠ হয়ে গেলাম। ম্যাডাম তাকাল, দেখল কি না জানি না, কোনও কথা না বলে চলে গেলেন ভেতরে।  

খানিক বাদে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, প্লেটের কোনায় আলুভর্তা, আর গোটা দুই বেগুন ভাজি নিয়ে উদয় হল ছন্দা! ঝলমলে চোখে ওর দিকে তাকানু, ছন্দা ঠাণ্ডা শীতল গলায় বলল, “নেন, খান।“ 

প্যাড়া নাই! 

প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। ততক্ষণে ছন্দা আবার নিজের সোফায় নিজের গেমসে ঢুকে গেছে। 

ক্ষানিক বাদে ভেতর থেকে “তিতির” বলে এক মহিলাকন্ঠ ডাক দিল। ম্যাডাম।  ছন্দা উঠল, পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। 

খাচ্ছি ঠিকই, ওদিকের কথাও কানে ঢুকতেছে। আল্লারে! 

“কে আসছে রে?” 

“মাহিন ভাই!” 

“আবার আসছে সে? কী চায়?” 

“জানো না? টিউশনি ছাড়ায়ে দেয়াড় পড় যতবার আসছে সে কী চাইছে?” 

“ কী দিলি? ওই কষানো মাংসগুলা সব ওর পলেতে দিয়া আসছিস, না?” 

ছন্দা তাড়াতাড়ি করে উত্তর দেয়, “না না, মাংস দিইনি, মাংস দিইনি! ওই… ফ্রিজে একটু বাসি ভাত ছিল, আর একটু আলুভর্তা!” 

“হুম! একটু ডাল টাল দিস, নাইলে আবার খারাপ দেখাবে।”

ছন্দা যখন ফিরল আমার খাওয়া শেষ প্রায়। ছন্দা অবশ্য খেয়ালই করে নাই, ও গেমসে ঢুকে গেসে। ডাইনিং টেবিলের কাছেই বেসিন। হাত ধুনু, প্লেট ধুনু, আবার টেবিলে থুনু। একটু কইরা গলাডা খাঁকারি দিনু। 

“কি কেলছো ছন্দা?” 

ছন্দা তাকাল। বড় বড় মাথা খারাপ করা দেবীচক্ষু দিয়ে সে তাকাল। সে কি চোখে কাজল দিসে? ওর কি চোখের নিচে কালশিটে পড়সে? আল্লারে, ছন্দার যেন কিছু না হয়! 

ছন্দার মোবাইল স্ক্রিনে দেখি সে ধুমসে দাবা খেলতেসে। আমারে বলে, “ভাইস সিটি!” 

আমি বললাম, “বুঝলা চণ্ডা, দাবাড় মত ভায়োলেন্ট গেম দুনিয়াতে নাই, পুরাটা সাইকোলজিক্যাল>।।“ 

আরও কি কি যেণ বলতে নিসিলাম, ছন্দা ততক্ষণে উঠে সদর  দরজা খুলে দাঁড়ায়ে আছে। মন চাইল বলি, এক কাপ চা খাওয়াবে? ওর তাকানো দেখে আর সাহস পানুনি। কথা না বাড়ায়ে বের হয়ে গেলাম।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করসি, ওমা! 

পেছন থেকে ডাক এল, “শোনেন!” 

ঠান্ডা ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প

সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করসি, ওমা! 

পেছন থেকে ডাক এল, “শোনেন!” 

ফিরে তাকানু।

ছন্দা দরজা থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি দুই কদম উঠলাম।

ছন্দা বলে, “ আমরা সামনের মাস থেকে এই বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।”

ইঙ্গিত স্পষ্ট। মাথা নিচু করনু, সবসময় যা করি।

আল্লা! তাকয়ে দেখি, ছন্দা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করসে, আমার হাতে ধরিয়ে দিল।

“ঠিকানা, নতুন বাসার। চেষ্টা করবেন কম আসতে!”

আমি তাকায়ে আছি।

ছন্দা তাকায়ে আছে।

একশ বছর পড়ে আমি বললাম, “কিন্তু ছন্দা, তোমার আম্মু যে… “

ছন্দার চিৎকারে এলাকা কেঁপে উঠল কি না জানি না, ছন্দা চেঁচিয়ে বলল,

“সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না কুত্তার বাচ্চা!”

অকল্পনীয় রাগে থরথর করে কাপছে মেয়েটা। চোখ ঠিকরে জল বেরতে চাইছে, কিন্তু শি ইজ সাচ এ প্রাউড ফ্লাওয়ার! আমারে তাঁর কান্না দেখতে অবধি দেবে না! প্যাড়া নাই!

আমি মাথা নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলাম। বাসার ইদুরছানা গুলা অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা আমার প্রিয় শব্দ না, সময় ও মাহীন কারও জন্য অপেক্ষা করে না!

Scroll to Top