এক যুগ পেরিয়ে আমাদের ইনভেন্টর’স!

ইনভেন্টর’স পাপেট

২০১২’র দিককার কথা! একটা স্বপ্ন বীজের সন্ধান করে আনলেন তরুণ শিল্পী শুভঙ্কর দাশ শুভ— একটুও অপেক্ষা না করে বুনে দিলেন সেই বীজ! যেন উর্বর ভূমিতে একটু জল পেতেই সেই বীজ পেয়েছে এক দুরন্ত শৈশব! আসলে বলছি বাংলাদেশে শিশু শিক্ষায় পাপেট্রির কথা। শিশুর শিক্ষায় পাপেট্রিকে শেখানোর হাতিয়ার হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করবার বুনিয়াদি চিন্তাটা সর্বাগ্রে ধারণ করলেন শুভঙ্কর দাশ শুভ। তার শৈল্পিক মনন, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং পাপেটের প্রতি ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় ইনভেন্টর’স পাপেট। প্রথম থেকেই সংস্থাটি বিশ্বাস করেছে, শিশুরা হাসতে হাসতে শিখতে চায়, আর শেখার পথ আনন্দময় হলে শিক্ষার প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যায়।

এই বিশ্বাস থেকেই গড়া “বিকশিত শিশু, আলোকিত পৃথিবী”— স্লোগান হয়ে উঠে ইনভেন্টর’স পাপেটের সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু।

বোকার সকল পাঠকদের জন্য আমাদের এবারের আয়োজন ইনভেন্টর’র পাপেটের আদ্যোপান্ত নিয়ে- চিন্তা ও চর্চায় ইনভেন্টর’স পাপেটের বারো বছরের একটি কাঠামোগত বিশ্লেষণ। বোকার সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন, শুভঙ্কর দাশ শুভ! পুরো লেখাটি পাঠককে ঋদ্ধ করবে; একইসাথে বাংলাদেশে পাপেট্রির সম্ভাবনা নিয়েও একটা সম্যক ধারণা দিবে বলে আশা রাখছি! 

Table of Contents

ইনভেন্টর’স পাপেট

বিকশিত শিশু, আলোকিত পৃথিবী

‘টেকসই উন্নয়ন থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সচেতনতার পরিক্রমায় আমাদের এই সংস্থা’

ইনভেন্টর’স পাপেট

শুভঙ্কর দাশ শুভ’র কাছে জানতে চাইলাম প্রতিষ্ঠানটি আসলে কী ধরনের কার্যপরিক্রমায় যুক্ত? উত্তরে জানালেন- শিশুদের হাসি, কল্পনা ও শেখার জগতে পাপেট একটি সেতুবন্ধনের কাজ করে। এ মাধ্যমটি শুধু বিনোদন নয়, বরং এক শক্তিশালী শিক্ষাদান পদ্ধতি হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে এই ভাবনার বাস্তব রূপ দিয়েছে ইনভেন্টর’স পাপেট, একটি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান যা গত ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে পাপেটকে ব্যবহার করছে শিশুদের আনন্দময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে।

শিশুদের জন্য একটি আন্দোলন

বাংলাদেশে যেখানে পাপেটকে এখনও অনেকেই শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখে, ইনভেন্টর’স পাপেট সেটিকে রূপ দিয়েছে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক, শিক্ষামূলক ও প্রভাবশালী শিল্পমাধ্যমে। মঞ্চ, টিভি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, থিয়েটার, কর্মশালা, এবং স্কুলভিত্তিক শো—সবখানেই তারা শিশুদের কাছে পৌঁছেছে আনন্দ আর শেখার প্যাকেজ হয়ে।

পাপেট নিয়ে তিনটি উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন সিরিজ— “রংধনু ফুল,” “ছুটির আনন্দ”“গল্পের দেশে”—দর্শকদের মন জয় করে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য তৈরি এই সিরিজগুলো পাপেট মাধ্যমে শিক্ষার সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করেছে।

এছাড়াও শিশু কিশোরদের বিজ্ঞান মনস্কো করার জন্য বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ সোনার কাঠি রুপার কাঠি ও আইনস্টাইনের আদলে “ভুলোস্টাইন” বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বমানের স্বীকৃতি ও অংশীদারিত্ব

ইনভেন্টর’স পাপেট শুধু দেশীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, সেভ দ্য চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল সহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান পাপেট্রিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে আনতে সক্ষম হয়েছে।

২০২৩ সালে ইনভেন্টর’স পাপেট বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাপেট সংস্থা UNIMA-এর সদস্যপদ অর্জন করে, যা বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। এটি প্রমাণ করে, বাংলাদেশেও পাপেট একটি শক্তিশালী, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পমাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

শিক্ষায় পাপেট্রির নতুন দিগন্ত

শিশুদের শেখানো, মনোযোগ ধরে রাখা, ও নৈতিকতা শেখানোর ক্ষেত্রে পাপেটের বিকল্প খুব কম। ইনভেন্টর’স পাপেট এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কাজ করছে SDG (Sustainable Development Goals) অর্জনে—বিশেষ করে গুণগত শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, সুস্বাস্থ্য ও জলবায়ু সচেতনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।

তারা STEAM (Science, Technology, Engineering, Arts & Mathematics) শিক্ষায় পাপেট্রিকে যুক্ত করে বাস্তবভিত্তিক অভিজ্ঞতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা বিকাশে সহায়তা করছে। শিশুদের মধ্যে পরিবেশ ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই সংস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পাপেট ক্যারেক্টার; শিশুদের সুপারহিরো

ইনভেন্টর’স পাপেট এমন কিছু আইকনিক ক্যারেক্টার তৈরি করেছে যাদের শিশুরা নিজের বন্ধু, শিক্ষক কিংবা সুপারহিরো হিসেবে দেখে—যেমন বুলু, জিনিয়া, টুবাই, টুবলু প্রভৃতি। এসব চরিত্র শুধু বিনোদন দেয় না, বরং শেখায় কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয়, ভালোবাসতে হয়, প্রকৃতি রক্ষা করতে হয়।

শিশুরা এই পাপেট চরিত্রগুলোর সাথে ইন্টার‍্যাক্টিভ শো বা ভিডিও কন্টেন্টে সরাসরি যুক্ত হতে পারে, যা তাদের মধ্যে শিক্ষাকে করে তোলে আনন্দদায়ক ও স্মরণীয়।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাপেট: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যদিও পাপেট্রি একটি প্রাচীনতম শিল্প মাধ্যম, কিন্তু বাংলাদেশে এর প্রতিষ্ঠানিকতা সহজ ছিল না। প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে পাপেটের অবস্থান নিশ্চিত করতে ইনভেন্টর’স পাপেটকে পেরোতে হয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ—অর্থায়ন, পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, মিডিয়ার অগ্রাধিকার প্রভৃতি।

তবে, ইনভেন্টর’স পাপেট আজ ছোট করে হলেও নিজস্ব স্টুডিও, ট্রেইনিং সেন্টার, পাপেট ওয়ার্কশপ, ও রিসার্চ-বেজড প্রজেক্টে কাজ করছে। তারা নিজেরাই পাপেট ডিজাইন করে, সেগুলোর প্রপস ও পোশাক তৈরি করে এবং শিশুদের জন্য অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট নির্মাণ করে। এক্ষেত্রে তারা অংশীদার প্রতিষ্ঠানের সাথেও বিভিন্ন প্রজেক্ট করে।

ইনভেন্টর’স পাপেট ইনস্টিটিউট; ভবিষ্যতের জন্য বীজ বপন

শুধু একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, ইনভেন্টর’স পাপেট ভবিষ্যতে “ইনভেন্টর’স পাপেট ইনস্টিটিউট” গঠন করে শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত পাপেট থিয়েটার, কারুশিল্প, পারফরমেন্স আর্টস, সামাজিক শিক্ষার ওপর কোর্স চালু করতে চায়। এখানে শিশুরা শেখাবে, শিখবে এবং নিজেদের গল্প নিজে বলবে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পাপেট; সচেতনতায় শিল্পের হাত

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। এই প্রেক্ষাপটে ইনভেন্টর’স পাপেট জলবায়ু সচেতনতায় কাজ করছে পাপেট শো ও এক্টিভেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে। এতে করে শিশুরা শিখছে প্রকৃতি ভালোবাসতে, জলবায়ু সংরক্ষণ করতে এবং সচেতন নাগরিক হতে।

ফেস্টিভ্যাল ও আন্তর্জাতিক কর্মশালার অভিজ্ঞতা

নাট্যশিল্পের ভেতরে এক বিস্ময়কর শাখা হলো পাপেট্রি—যা কেবল শিশুতোষ বিনোদন নয়, বরং সংস্কৃতি, প্রতিবাদ এবং শিক্ষা-সচেতনতার এক গতিশীল মাধ্যম। এই উপলব্ধিকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের পাপেটচর্চার এক স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করে চলেছে Inventor’s Puppet

২০১৭ সালে আয়োজিত Inventor’s Puppet Festival ছিল বাংলাদেশের পাপেটচর্চায় এক মাইলফলক। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই উৎসবে অংশ নেয় দেশের বিভিন্ন পাপেট দল, শিশু-কিশোর শিল্পী, শিল্প-সংগঠক এবং নাট্যপ্রেমীরা। এই উৎসবে শিশুদের সঙ্গে বাবা-মা, শিক্ষক এবং গবেষকরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, যা পাপেটকে একটি আন্তঃপ্রজন্মীয় মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

২০১৮ সালে Inventor’s Puppet-এর উদ্যোগে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ-এর সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক পাপেট কর্মশালা। এতে অংশগ্রহণ করে ভারত ও বাংলাদেশের পাপেট্রি অনুশীলনকারী ও গবেষকরা। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী বিদেশি শিল্পীরা বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি ও পাপেট অনুশীলনের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। একইসাথে, বাংলাদেশি তরুণরা আন্তর্জাতিক পাপেট শিল্পের ধারা, কাঠামো ও কৌশল সম্পর্কে সরাসরি জানার বিরল সুযোগ পান।

ডিভাইস যুগে পাপেট: আজকের শিশুরা প্রযুক্তি নির্ভর—স্ক্রিন তাদের প্রিয় সঙ্গী। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই ইনভেন্টর’স পাপেট তৈরি করেছে ভিডিও কন্টেন্ট, অ্যানিমেটেড সিরিজ, এবং ইউটিউব শো, যা শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখে এবং শিক্ষার বার্তা পৌঁছে দেয়।

যাঁদের হাত ধরে এই স্বপ্নযাত্রা!

সামগ্রিক অর্থে সাফল্যের মাপকাঠিতে ফেলছি না; তবুও ইনভেন্টর’স পাপেটের সাফল্যের পেছনে রয়েছে একটি ছোট কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ দল।

জনা পাঁচ-এক পাপেটিয়ার শিশুদের সামনে তুলে ধরছেন- জীবন্ত চরিত্র! দু’জন স্ক্রিপ্ট রাইটার গল্পে যুক্ত করেন শিক্ষার রসদ। একজন ক্রিয়েটিভ চরিত্র ও কনটেন্ট ডিজাইন করেন, একজন ব্র্যান্ড ও মার্কেটিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। ফাইন্যান্স কর্মকর্তা অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় নজর রাখেন, আর পাব্লিক রিলেশন সদস্য সংযোগ স্থাপন করেন দর্শক ও অংশীজনদের সঙ্গে।

যদিও প্রতিষ্ঠানটির CEO ও বিজনেস রিলেশন প্রধান নেতৃত্ব দেন সামগ্রিক দিকনির্দেশনায় এবং প্রজেক্ট ম্যানেজার মাঠপর্যায়ে কাজের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন। সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ আর প্রচেষ্টা ইনভেন্টর’স পাপেটকে করে তুলেছে একটি গতিশীল ও শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠানে।

নতুনের কাছে

ইনভেন্টর’স পাপেট
ছবিতে ইনভেন্টর’স পাপেটের প্রতিষ্ঠাতা শুভঙ্কর দাশ শুভ

ইনভেন্টর’স পাপেটের প্রতিষ্ঠাতা শুভ জানালেন, পাপেট্রি করতে হলে শুধু কৌশল নয়, থাকতে হয় ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা। এই শিল্পে রয়েছে নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত ও কারুশিল্পের মিশ্রণ। তাই পাপেট্রিকে বলা যায় শিল্পের এক পূর্ণাঙ্গ রূপ, যেখানে হৃদয় ও কল্পনার মিলন ঘটে। ইনভেন্টর’স পাপেট ভবিষ্যতের শিল্পী, শিক্ষক ও স্বপ্নদর্শীদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে।

ইনভেন্টর’স পাপেট একটি আন্দোলনের নাম—যা শিশুদের হাসিমুখে শেখায়, সামাজিক বার্তা দেয়, ন্যায়বোধ জাগায় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এক আলোর মশাল জ্বালিয়ে যায়। এই প্রতিষ্ঠান দেখিয়েছে, যদি ইচ্ছা থাকে, তবে পাপেট দিয়েও বদলে ফেলা যায় পৃথিবী। ইনভেন্টর’স বিশ্বাস করে- এই শিল্প একদিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবে এবং বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে শিশুদের শেখানোর সবচেয়ে সুন্দর উপায় হয়ে উঠবে।

২০১২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইনভেন্টর’স বিভিন্ন সহায়ক কার্যক্রমে- শিক্ষায় পাপেট, শিশুতোষ পাপেট শো, ওয়ার্কশপ, SDG প্রকল্প, পাপেট থিয়েটার, চরিত্র নির্মাণ, ভিডিও কনটেন্টসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ এবং শিশুবান্ধব বিষয়ে অংশ নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতা ইনভেন্টর’স- বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, UNIMA, UNDP, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, Winrock International এর অংশীদারিত্বে সহযোগী হিসাবে কাজ করছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি দেশব্যাপী বছরে প্রায় ৩০-এর অধিক শো পরিচালনা করে থাকে।

বাংলাদেশের শিশুদের জন্য নিবেদিত এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য বোকার পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা এবং এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি!
-বোকা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top