বোকার লোকাল ট্রেনে!
Reading Time: 14 minutesখুব গহীনে থেকেও বোকা অপার বিস্ময়ে দেখে গভীর নীরবতাকে। নীড়ালের কোলাহলকে। কী এক গহীন সুর তাকে মায়ায় বাঁধে। এই শহরে, নগরে, বন্দরে বোকার নাভিশ্বাস। আর গহীনেই তার মুক্তি। বোকা ধরতে চায় প্রাণমাখা প্রাণ। বোকা উঠে যায় বোকাদের লোকাল ট্রেনে। যাত্রী হয়ে বনের গান হয়ে। পাখির কলরব হয়ে কিংবা নদীর ধীরলয় স্রোত হয়ে। বোকা যায় এঁকেবেঁকে স্টেশন থেকে স্টেশনে। পৌষে-মাঘে, অগ্রাণে-কার্তিকে, আশ্বিনে ভরা ভাদ্দর, বুক পকেটে রাখা জোনাক ফুলের মিঠা শাওনে-আষাঢ়ে, মধু জৈষ্ঠ্যে কিংবা উত্তাল বৈশাখে বোকা ট্রেন ঝক ঝকাঝক ছুটে চলেছে। ছুটে চলেছে তেপান্তরের মাঠে কিংবা মনোভূমির এক আদি গন্ধে।
বাংলায় এক সময়ে ২৫০ ধরনের লোক সংগীতের ধারা বহমান ছিল। মানুষের প্রতিদিনকার প্রতিটি সময় প্রতিটি কাজে গানের কলরব ছিল। মানুষ ছিল সহজিয়া, সারল্যে ভরা, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। আমার আমাদের সেই সরল সুন্দর মুখর প্রাচুর্য হারিয়ে এখন হাপিত্যেশ করি। বোকা সংশয়বাদী নয়। অথচ বোকা খুব গোপনে তার হারানো সুরগুলোর কাঁদন শোনে। নিজে কাঁদে।
বোকার লোকাল ট্রেন নিয়ে মেহেদী হাসান স্বাধীনের কথা হলো ট্রেনের চালকের সাথে। চালক ফজলুল হক নয়ন। আপাদমস্তক গীতানুরাগী কবি গায়ক শিল্পী। বোকা সমাজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল লোকাল ট্রেনের যাত্রা বিরতিতে কথা কইতে। তাই বোকার আজকের বোকাতিথি ফজলুল হক নয়ন, বোকায় উপস্থিত হয়েছেন তার লোকাল ট্রেন নিয়ে।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: ভরা পৌষের শুভেচ্ছা আপনাকে। কেমন আছেন?
ফজলুল হক নয়ন: শুভেচ্ছা পৃথিবীর সব বোকাদের। বোকা এতো কঠিন প্রশ্ন করবে জানতাম না। একা তো ভালো থাকা যায় না, মন আইঢাই করে। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হয়। সেই সুযোগ এই নগর সভ্যতায় কতোটা এই প্রশ্ন রেখে বলছি, হুম নিজের মতো আছি।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের শুরুটা বলনু।
ফজলুল হক নয়ন: এই ট্রেনের যারা মাঝি-মল্লা তাদের অনেকই গানের সাথে সরারসরি জড়িত বাকি সবাই গানের অনরুাগী। নানান দেশের নানান ভাষার গানের অলিগলি ঘুরে আমাদের শেকড়ে ফেরার তাগাদা অনভুব করি। আর সেই চিন্তা থেকেই লোকাল ট্রেনের শুরু।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের গন্তব্য কোথায়? ফজলুল হক নয়ন: লোকাল ট্রেনের গন্ত্যব্য এক কথায় বাংলা গান আরো ছোট করে বললে বাংলা লোকোগান। যে গান বাংলার মাটি, পানি, বায়ু আর বর্ণমালার সমবয়সী সেই লোকগান। যে গান পৈত্রিক পরিচয় বহন করে, যে গান আমাদের দরদের ভাই বন্ধুজনা, যে গানে প্রেম বন্দনা বা পরমের প্রার্থনা বাঙ্গালির অনভূতির আগমনীর থেকে বিসর্জন সব অনভূতি যে লোকসুরে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে সেই লোক গান।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের স্টেশন নিয়ে বলুন।
ফজলুল হক নয়ন: লোকাল ট্রেনের স্টেশন বাংলা লোকসঙ্গীতের সব ঘরানা। বাস্তবিক অর্থে লোকাল ট্রেন যেমন ছোট বড় সব স্টেশনেই দাড়ায়; যাত্রী নেয় ধীরে সুস্থে। আমাদেরও ঠিক তাই। আর সেই ধারণা থেকেই এই নামকরণ ও কোনো তাড়া নেই আমাদের ,আর তাড়াহুরো করে নিশ্চয়ই কেউ গান শোনেও না, গান শোনার জন্য আমার কখনো তাড়াহুরো করে হাতের কাজ সারি। কিন্তু লোকাল ট্রেন আসলে বাংলা গানের দাওয়ায় বসে বাংলা গান শোনার আয়োজন।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের যাত্রী কারা?
ফজলুল হক নয়ন: লোকাল ট্রেনের যাত্রী লোকাল ট্রেনের স্রোতারা। যারা, আমাদের মতো, যাদের- বাংলা গানের জন্য মন কেমন করে , নদীর মৃত্যু যাদের ভাবায়, নগর সভ্যতার এই পোশাকি জীবন যাদের ক্লান্ত করে। লোকাল ট্রেনের সফরে আমরা তাদের দাওয়াত জানাই।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: বাংলা গানের কোন রূপ ধরে লোকাল ট্রেন তার গন্তব্যে যাচ্ছে?
ফজলুল হক নয়ন: লোকগান। তথ্য বলে, বাংলায় এক সময়ে ২৫০ ধরনের লোক সংগীতের ধারা বহমান ছিল কিন্তু আজ তার কতোগুলি বর্তমান সে সংখ্যা আর নাই হিসাব করলাম, কী ঐশ্বর্য্য, কী রত্ন আমরা হারিয়ে ফেলেছি, হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে সে দুঃখও আরেক বিষণ্ন সুর।
গানও কি নদীর মতো মরে যায়? নাকি হারিয়ে যায় শৈশবের মতো? বা, বেঁচে থাকলে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের মতো, গানও কি জীবিত স্বত্তা? আমাদের মানচিত্র জুড়ে নদী যেমন শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে, তেমনি লোকসঙ্গীতও যেন আমাদের আটপৌড়ে জীবনের সুখ দুঃখের দিনলিপি। ভালো লাগা না লাগার, এই শহরে প্রতিদিনের এই ভিড়, গাদাগাদি, ধুলাবালি, মারামারি, মহামারি, টাকাপয়সা, ধারদেনা, মিথ্যে কথা, মিথ্যে হাসি আর ঘাম বিনিময়ের এই শহরে সবার মতো আমাদেরও ক্লান্ত লাগে। ছুটি নিয়ে চাপি লোকাল ট্রেনে… পড়ান জুড়াই বাঙলা গানে।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেন কেন মিউজিক্যাল জার্নি?
ফজলুল হক নয়ন: এই সফরে ধর্ম কর্ম সবই গান। লোক গানের সুরই আমার কাছে সুরা বাণী। আমাদের জীবন কথা, আর তাই লোকাল ট্রেন আমাদের কাছে এক লোক গানের কাফেলা।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের স্টেশন এবং বগি সংখ্যা বাড়াতে কী কী উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন?
ফজলুল হক নয়ন: লোকাল ট্রেনের একটাই বগি একটাই শ্রেণী। যে কারণে- কেউ এই ট্রেনের যাত্রী হয়। সেই একই কারণে এই ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে এবং পরিচালিত হচ্ছে। আর সেই কারণটা হচ্ছে, আমাদের শেকড়ে ফেরার ক্ষুধা।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের অপেক্ষমান যাত্রীদের জন্য টিকিটের কি করলেন?
ফজলুল হক নয়ন: টিকেট মূল্য এখানে কেবল বাংলা গানের ভালোবাসা। আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। শ্রোতাদের কাছে বায়লা গান পৌঁছে দিতে। একইসাথে চেষ্টা করে যাচ্ছি আমাদের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠতে।
লোকাল ট্রেনের টিকিট কাটুন বিনামূল্যে: বগি-ক,বগি-খ
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেন নিয়ে কোন্ স্বপ্নের স্টেশনে পৌঁছাতে চাচ্ছেন?
ফজলুল হক নয়ন: স্বপ্ন অনেক বড়! আমরা চাইছি বাংলা লোকসংগীতের একটা মানচিত্র তৈরি করতে। হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছুই আজ আর বর্তমান নয় , অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে জানি, তবু…… যতটুকু পাই , নদী মরে গেলেও যেমন তাঁর দাগ থেকে যায়। হয়তো গানের স্রষ্টার মৃত্যুর পর কয়েক প্রজন্ম চলে গিয়েছে বা নিভু নিভু করছে কোনো গানের ধারা।আমরা তুলে আনতে চাই সেগুলোকে, লিখে রাখতে চাই সেইসব বাণী সুর।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া কী?
ফজলুল হক নয়ন: আমরা সবে যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের যাত্রী সংখ্যাও নিতান্ত সামান্য। এবং খুব কম মানষুই আমাদের সম্পর্কে জানে। আমরা জানি এই নাগরিক জীবনে অনেকেই আমাদের মতো বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায় বাংলা গানে। আমরা আশাবাদী তারা নিরাস হবে না। কারণ আমরা গানের বাণীতে সুরে কোথাও কোনো হাত দেইনি, মাতুব্বরি খাটাইনি মূল গানে।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেন প্রত্যন্ত সুরগুলো কীভাবে তুলে আনছে?
ফজলুল হক নয়ন: যেটা আগেও বলেছি এই কাফেলার অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এগানের সাথে যুক্ত। সেহেতু বাংলা গান নিয়ে কাজ করার একদা দীর্ঘ একটা অভিজ্ঞতা আমাদের আছে এবং আরো বিশেষ করে বললে, বাংলা লোক সঙ্গীত নিয়ে।
সেই অভিজ্ঞতা, সাথে আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বা যে গান আসলে যেখানকার সেখান থেকে আমরা চেষ্টা করছি গান তুলে আনবার। সেই সাথে থাকছে সেই অঞ্চল-এর জীবন যাত্রার ছবি, দৃশ্যপট।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেন কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা এবং সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে?
ফজলুল হক নয়ন: পৃষ্ঠপোষকতার।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেন কি কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করছে? না করলে কেন? এবং করলে কী ধরনের কিংবা কাদের? আর যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক উদ্যোগ হয় কীভাবে সামাল দিচ্ছেন?
ফজলুল হক নয়ন: পৃষ্ঠপোষকতা আসলে আমরা এখনো চাইনি, তবে চাইবো। এখন পর্যন্ত পুরোটাই নিজেদের অর্থায়নে; যেটাকে ভদ্দর নোকেরা সেল্ফ ফান্ডেড বলে আরকি!
*** দান্দ্বিক মধ্যবিত্তের ঘরে মার্ক্স, পড়তে ক্লিক করুন এখানে। ***
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেন ঠিক এখন কোন স্টেশনে আছে?
ফজলুল হক নয়ন: আসলে, আমরা এখনো পাইলট প্রজেক্টে আছি। বলতে পারি, মাথায় জেতা (যেসব) আছে তাঁর অনেকটাই করা যাচ্ছে না; ভীষণ রকম বাস্তবমখুী কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের পরবর্তী স্টেশন কোথায়?
ফজলুল হক নয়ন: ঠিকানা অজ্ঞাত, রাধারমণও হতে পারে বা বিজয় সরকারও হতে পারে বা বিয়ের গীত।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের তার যাত্রীদের কী বলতে চায়?
ফজলুল হক নয়ন: শেকড়কে যেন না ভুলি আমরা।
পরাণ জুড়াই বাংলা গানে
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেন কি সমসাময়কি বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে কথা বলছে? নাকি সময়কে ধরে পেছনের অতীত খুঁজে বেড়াচ্ছে?
ফজলুল হক নয়ন: একেবারেই বাস্তবতা বিমুখ নই আমরা, বরং বাস্তবতার চাপেই বরং আমাদের তাগাদা বেশি, অনেক দেরি হয়ে গেছে শুরু করতে, আমরা মনে করি বর্তমান মানে অতীতকে ভুলে যাওয়া নয়, এই মুহূর্তের বর্তমান পর মুহূর্তেই অতীত, অগ্রগতি বা প্রগতি মানে অতীতকে ভুলে যাওয়া নয়। এর শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সে তো আরো প্রবল। আমাদের বারবার পেছনের পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে হয়। আর তা যদি শুধু বিনোদনের জন্যও যদি হয় সেক্ষেত্রে ও নিজের শেকড়ে ফেরার চেয়ে শান্তির আর কী আছে? আমরা বলি পরাণ জুড়াই বাংলা গানে।
মেহেদী হাসান স্বাধীন: লোকাল ট্রেনের বিশেষত্বটা কী?
ফজলুল হক নয়ন: আরো পরে বলি, আগে যাত্রাটা শুভ হোক, নিরবিচ্ছিন্ন হোক…
মেহেদী হাসান স্বাধীন: অনেক ধন্যবাদ। পৃথিবীর সকল বোকা সরল প্রাণের পক্ষ থেকে লোকাল ট্রেনের সংশ্লিষ্ট সকলকে শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা।
ফজলুল হক নয়ন: বোকা প্রাণ নিঃসন্দেহে সরল সহজিয়া। বোকাকেও আমাদের ট্রেনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ভালোবাসা।
পুনঃশ্চ: পাঠক বোকার সাথে প্রজেক্ট লোকাল ট্রেনের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। সে নিয়ে পরে নিশ্চয়ই কথা হবে। আপনাদের সুবিধার্তে এই লেখায় লোকাল ট্রেনের ওয়েব সাইট এবং ইউটিউব লিংক বগি-ক, বগি-খ তে তুলে দেয়া হয়েছে। বোকা যাত্রীর ভালোবাসায় লোকাল ট্রেন পৌঁছে যাবে সকল প্রত্যন্ত স্টেশনে। সর্ববোকাপ্রাণের কাছে এই প্রত্যাশা থাকলো। -সম্পাদক